• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
ফের ভাঙল জাতীয় পার্টি

ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতি

ফের ভাঙল জাতীয় পার্টি

রওশনকে চেয়ারম্যান ঘোষণা, মহাসচিব অভিন্ন

  • এ এইচ এম ফারুক
  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি ফের ভেঙেছে। এর আগে কয়েক দফায় দলের নেতাদের হাতে ভাঙলেও এবার এরশাদের ভাই ও পত্নীর দ্বন্দ্বে ভাঙল।

এরশাদ প্রয়াত হওয়ার পর মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এরশাদের রেখে যাওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার এ পদে এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের নাম ঘোষণা করেছেন পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। দুপুরে রওশনের গুলশানের বাসভবনে তার উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা করেন তিনি। এ সময় জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করে চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, পার্টির মহাসচিব থাকবেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। আগামী ছয় মাসের মধ্যে কাউন্সিল করা হবে। এর আগে সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান (নবঘোষিত চেয়ারম্যান) রওশন এরশাদ বলেন, আসুন সবাই মিলে পার্টিটাকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করি। এর আগে বিভিন্ন সময় জাতীয় পার্টি পাঁচবার ভেঙেছে।

তবে জাপা ভাঙেনি দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তিনি বলেছেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা নিয়ে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। জাপা ভাঙেনি। কোনো ভাঙনের মুখে পড়েনি। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো ঘোষণা দিলেই তো তা বাস্তবায়ন হয় না।’

এর আগে ১৪ জুলাই জাপার চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর চার দিন পর ১৮ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। এরপর ২৩ জুলাই জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে অস্বীকার করে বিবৃতি দেন রওশন এরশাদসহ দলের সাত সংসদ সদস্য ও দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। তবে পরবর্তী সময়ে এরশাদের চেহলাম উপলক্ষে কয়েকটি মিলাদ মাহফিলে একসঙ্গে দেখা যায় রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরকে।

এদিকে উভয় অংশে মহাসচিব হিসেবে মসিউর রহমান রাঙ্গাকে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার মতামত জানার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দলীয় সূত্র বলছে, দলের চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি সম্প্র্রতি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার মনোনয়ন নিয়েও সংকট তৈরি হয় জাপায়। বিষয়টি নিয়ে গত দুই দিন ধরে চলছে চিঠি, পাল্টা চিঠি চালাচালি। এই ইস্যুতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সংসদ সদস্যরা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এক পক্ষ চায় জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে। অন্য পক্ষ চায় রওশন এরশাদকে।

এ নিয়ে গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকালে দলীয় প্যাডে নিজেকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদে নিয়োগ দিতে স্পিকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার  জন্য চিঠি দেন জিএম কাদের। এরপর বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) জিএম কাদেরের চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা গ্রহণ না করার অনুরোধ জানিয়ে পাল্টা চিঠি দেন রওশন এরশাদ।

এরশাদের জীবিত অবস্থায়ই জাপা এরশাদপন্থি ও রওশনপন্থি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এরশাদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা জিএম কাদেরপন্থি নামে পরিচিতি পান। এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচন নিয়েও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রয়েছে জাপায়। রওশনপন্থিরা চান এ আসনে এরশাদের  ছেলে রাহগির আল মাহিরকে (সাদ এরশাদ)। অন্যদিকে জিএম কাদেরপন্থিরা চান এরশাদের ভাই বা স্থানীয় নেতাদের মধ্যে কেউ নির্বাচন করুক।

গতকাল চেয়ারম্যান ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদ বলেন, ‘এরশাদ সাহেব তিলেতিলে পার্টিটাকে কষ্ট করে গড়ে তুলেছেন। এখন সেই পার্টিটাকে ভালো করতে চাই।’

পুরনো যারা জাতীয় পার্টি থেকে ছেড়ে গেছেন, তাদের নতুন করে দলে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রওশন বলেন, ‘মান-অভিমান ভুলে দেশ ও মানুষের স্বার্থে জাতীয় পার্টির পতাকাতলে আসুন। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে জাতীয় পার্টিকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।’

ইসিকে চিঠি : জাতীয় পার্টির একাংশের সংবাদ সম্মেলনে রওশন এরশাদকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণার পর তার স্বাক্ষর ছাড়া অন্য কারো স্বাক্ষর গ্রহণ না করতে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছে দলটির রওশনপন্থি অংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে আগারগাঁওয়ে ইসি কার্যালয়ে চিঠি পৌঁছে দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করেছেন রওশনপন্থিদের অন্যতম নেতা ফখরুল ইমাম এমপি।

তিনি বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এখন থেকে রওশন এরশাদের স্বাক্ষর ছাড়া যেন অন্য কারো স্বাক্ষর গ্রহণ না করা হয়, এ বিষয়টি জানানো হয়েছে।

এদিকে প্রায় একই ইস্যুতে একটি চিঠি কিছুদিন আগে জিএম কাদেরের পক্ষ থেকেও নির্বাচন কমিশনে পৌঁছানো হয়েছে।

নতুন সংসদীয় বোর্ড গঠন : এদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলের সংসদীয় বোর্ড গঠন করেছেন জাপার রওশনপন্থিরা। রংপুর-৩ নির্বাচনী আসনে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণে ১৩ সদস্যের এই বোর্ডে আরেক অংশের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকেও রাখা হয়েছে বলে জানান ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আমরা বোর্ড গঠন করেছি। এতে জিএম কাদেরও পদাধিকার বলে আছেন। কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে মসিউর রহমান রাঙ্গার নাম রয়েছে।

আগামী রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) সংসদীয় বোর্ডের বৈঠক ডেকেছেন রওশন এরশাদ। সেদিন জাতীয় সংসদে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান ফখরুল ইমাম এমপি।

জিএম কাদেরের সংবাদ সম্মেলন : রওশনপন্থিদের এ ঘোষণার প্রতিক্রিয়া জানাতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জিএম কাদের এক সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি জাপার প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের বিভিন্ন নির্দেশনা পাঠ করে শোনান।

গঠনতন্ত্রের ২০/ধারা ক উপধারার উদ্ধৃতি করে জিএম কাদের বলেন, ‘আমাকে এরশাদ সাহেব তার অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করতে নির্বাচিত করেছেন। গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার ক উপধারায় বলা আছে, চেয়ারম্যান জাপার যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ ও নিজের স্থলাভিষিক্ত করতে পারবেন। এইচএম এরশাদ আমাকে তার স্থলাভিষিক্ত করে গেছেন। মৃত্যুর আগে আমাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর কী হবে, সেটা গঠনতন্ত্রে বলা নাই।’

তিনি জানান, এরশাদের মৃত্যুর পর প্রথম প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে অভিনন্দিত করা হয়। তিনি আরো জানান, ‘কাউন্সিল ছাড়া অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করা যাবে না। তার (এইচএম এরশাদ) অবর্তমানে আমাকে স্থলাভিষিক্ত করে গেছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাকি চেয়ারম্যান তা এরশাদ সাহেব বলে গেছেন।’

তিনি বলেন, ‘দলের এমপিদের কাছে জানতে চেয়েছি কার প্রতি তাদের আস্থা আছে। ২৫ জন এমপির মধ্যে ১৫ জন আমার পক্ষে রয়েছেন। এর আগে জাতীয় সংসদে দলের নেতা এরশাদ দিয়েছেন, এমপিদের মতামতের ভিত্তিতেই দিয়েছেন।’

বিরোধীদলীয় নেতার পদ পাওয়া প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা যা করেছি তা আইনসম্মতভাবে করেছি। গঠনতন্ত্র মোতাবেক করেছি। কাউকে ছোট করার জন্য করিনি।’

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হাসান বাবলা, লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীসহ অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।

সাবেক মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু একই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এরশাদ মানে জাপা, জাপা মানে এরশাদ। তিনি (এরশাদ) জিএম কাদেরকে তার অবর্তমানে চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেছেন। আমরা রওশন এরশাদকে সম্মান করি, তিনি যা করেছেন তা নিয়ে আমরা কিছু বলব না।’

জাপায় বারবার ভাঙন : এ নিয়ে জাতীয় পার্টি এখন ছয় ভাগে বিভক্ত হলো। এর আগের ৫টি ভাগের মধ্যে চারটির নিবন্ধনও আছে নির্বাচন কমিশনে। তবে এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিই দলগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বড় দল। এই দলই বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল। এরশাদের নেতৃত্বাধীন এই অংশটি মূল জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত।

নির্বাচন কমিশনে এইচ এম এরশাদের নামে লাঙল প্রতীক নিবন্ধিত জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) নিবন্ধিত বাইসাইকেল প্রতীক নিয়ে, নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে। আর গত নির্বাচনের আগে এরশাদের দলে আরেক দফা ভাঙন ধরিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি করেন কাজী জাফর আহমদ। এর বাইরে কাঁঠাল প্রতীকে তাসমিনা মতিনের নামেও জাতীয় পার্টির নিবন্ধন আছে। জাতীয় পার্টির নেতা এম এ মতিনের নেতৃত্বে এই অংশটি আলাদা হয়েছিল।

এরশাদের জাপায় প্রথম ভাঙনের আঘাত হানে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে চারদলীয় জোটে চলে যায়। সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন।

২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে যায়। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান পার্থ।

এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আছে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার একপর্যায়ে জাপার প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন।

সর্বশেষ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরান তার পুরনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমদ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি জোটে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads