• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

রাজনীতি

ছাত্রলীগের আগাম সম্মেলন হচ্ছে

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

চলমান নানা ইস্যু ছাপিয়ে আবার নেতিবাচক আলোচনায় ছাত্রলীগ। রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুর মধ্যেও বড় হয়ে উঠেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। মূল দলের গুরুত্বপূর্ণ সভার আলোচনায়ও বিশেষভাবে স্থান করে নিচ্ছে সংগঠনটির নেতাদের শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণ। কেন্দ্রীয় নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং তাদের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগে ক্ষুব্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিতে বলেছেন সংগঠনের সাংগঠনিক নেতা, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ছাত্রলীগ নেতাদের ঢুকতে না দিতে এবং দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগঠনটিকে আমন্ত্রণ না জানানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এরপরও থেমে নেই সংগঠনটির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সংগঠনটিকে ঘিরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। একই সঙ্গে গুঞ্জন উঠেছে- বর্তমান কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ১১ মাস আগেই ছাত্রলীগের আগাম সম্মেলন হতে পারে। আগাম সম্মেলনের গুঞ্জন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তোলপাড় তুলেছে। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের হিসাবে ছাত্রলীগের দুই বছর মেয়াদি কমিটির সময় শেষ হবে আগামী বছরের ৩০ জুলাই বা আরো প্রায় ১১ মাস পরে। কিন্তু সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা অভিযোগসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগাম সম্মেলনের দাবি উঠেছে সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্য থেকেই।

ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর দায় সংগঠনটিকে নিতে হবে এবং জবাবও বর্তমান নেতৃত্বকেই দিতে হবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। দলের ভ্রাতৃপ্রতিম এ সংগঠনের নেতাদের বিতর্কিত কাণ্ডের দায় কেন্দ্রীয় নেতারা নিতে রাজি নন। তাদের মতে, ছাত্রনেতাদের দোষত্রুটি ধরা পড়লে অভিভাবক হিসেবে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের শাসন করতে পারেন। তবে ভুল নিজেদেরই শোধরাতে হবে।

ছাত্রলীগের আগাম সম্মেলনের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত আগাম সম্মেলনের কোনো সিদ্ধান্ত পাইনি। এটি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পুরোপুরিভাবে নেত্রী (শেখ হাসিনা) নিজেই দেখছেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। দলের চারজনকে (কেন্দ্রীয় নেতা) ছাত্রলীগের বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এখন যদি ছাত্রলীগের এই কমিটির ব্যাপারে নতুন কোনো বিবেচনা আসে, সংযোজন বা পরিবর্তনের কোনো প্রশ্ন আসে, নেত্রী নিজেই তা করতে পারেন।’

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘দলের সভাপতি আমাদের সব সংগঠনের অভিভাবক। সেই অভিভাবকই যখন কোনো সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের কারো প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন, তার প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, তাহলে সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।’

প্রধানমন্ত্রীর অসন্তোষকে যৌক্তিক ও সঠিক বলে মেনে নিয়ে নিজেদের শুধরে নিতে আরো সময় চান ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা। দুজনই বলছেন, ছাত্রলীগের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির যে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ও শিরোধার্য। সংগঠনটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, ‘নেত্রী (শেখ হাসিনা) যখন ইচ্ছা, তখন ভেঙে দিয়ে নতুন করে কমিটি দেবেন। এখানে আসলে আমাদের বলার কিছু নেই। নেত্রী যা করবেন, সেটাই ঠিক।’

সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘নেত্রী আমাদের মা, অবশ্যই আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো স্বীকার করে নিয়ে এই অনুতাপবোধ থেকে তার কাছে আমরা ক্ষমা চেয়ে বলব যে, আমরা আরো ভালো করে কাজ করতে চাই। তিনি কষ্ট পেয়েছেন, এটা আমরা নির্দ্বিধায় বুঝতে পারছি।’

তবে ছাত্রলীগের গত কমিটির কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক এবং নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিতদের মুখপাত্র রাকিব হোসেন বলেন, ‘তারা (সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) ছাত্রলীগকে কলঙ্কিত করেছেন। ছাত্রলীগে থাকার যোগ্যতা তাদের নেই। অচিরেই তাদের অপসারণ দাবি করছি। পাশাপাশি আগাম সম্মেলনেরও দাবি জানাচ্ছি, যেখানে ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করা হবে।’

গত শনিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উপস্থিত নেতাদের সমালোচনার একপর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দিতে বলেন শেখ হাসিনা। সে সময় ছাত্রলীগের সামপ্রতিক কর্মকাণ্ডে বিরক্তিও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবনের ওই সভায় উপস্থিত থাকা সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে এমন কথা বলেন। ওই সভায় তাদের সম্পর্কে নানা অভিযোগ তোলেন উপস্থিত নেতারা। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- বিতর্কিত ব্যক্তিদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া, দুপুরের আগে ঘুম থেকে না ওঠা ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি।

এরপর গতকাল বুধবার থেকে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গণভবনে প্রবেশের পাস বাতিল করা হয়। গণভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে এতদিন তাদের স্থায়ী অনুমতি ছিল। যেকোনো সময় তারা গণভবনে প্রবেশ করতে পারতেন। এ সুবিধা বাতিলের ফলে এখন তারা গণভবনে প্রবেশ করতে চাইলে আলাদা অস্থায়ী পাস নিতে হবে। অর্থাৎ আগের মতো আর সরাসরি গণভবনে প্রবেশ করতে পারবেন না তারা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি সাতদিনের মধ্যে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে গত ১৫ এপ্রিল নির্দেশ দিলেও নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে সংগঠনটির বর্তমান নেতৃত্ব ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বই এর মূলে বলে অনেকের ধারণা। নানা আলোচনা ও সমালোচনার পর পুরো কমিটি করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের চার নেতাকে। ছাত্রলীগের সম্মেলনের এক বছরেও সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে কমিটি করতে না পারায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ওই চার নেতাকে এ দায়িত্ব দেন।

কেন্দ্রীয় সম্মেলনের এক বছর পর গত ১৩ মে ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রলীগ। কমিটিতে অছাত্র, রাজাকার পরিবার, বিএনপি পরিবারের সদস্য, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবির, বিবাহিত, চাকরিজীবী, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত, হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন মামলার আসামি, সংগঠনের গঠনতন্ত্র নির্ধারিত বয়সোত্তীর্ণ, মাদক ব্যবসায় অভিযুক্ত, অপকর্মের দায়ে সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত ও সাজাপ্রাপ্তদের শীর্ষ পদে রাখার অভিযোগ ওঠে। বিতর্কিতদের বাদ দিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের ১৩ দিনের মাথায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মাত্র ১৯ জনের পদ শূন্য ঘোষণা করার কথা জানায় ছাত্রলীগ।

ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগেরই একাংশের হামলায় আহত হন নতুন কমিটিতে পদবঞ্চিত ১০ থেকে ১২ জন। পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিত ও পদকাঙ্ক্ষিত নেতাকর্মীদের সংবাদ সম্মেলনে সংঘর্ষ, কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া ও না পাওয়াকে কেন্দ্র করে ‘প্রতিপক্ষের’ বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একপক্ষের বিরুদ্ধে আরেক পক্ষের বিস্ফোরক মন্তব্য ও কমিটি ভেঙে দিতে পদবঞ্চিতদের ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়ার ঘোষণার ঘটনায় বিস্মিত হন আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েক নেতা।

তথ্যমতে, ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আড়াই মাস পর গত বছরের ৩১ জুলাই শোভনকে সভাপতি ও রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত হয়। ওই দিন গণভবন থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাদের নাম ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করেন। গত বছরের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন হয়। রীতি অনুযায়ী ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর দ্রুততম সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার কথা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads