• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮

রাজনীতি

এক কোটি টাকা ভাগবাঁটোয়ারার ফোনালাপ ফাঁস

  • শাহিনুর রহমান শাহিন, জাবি
  • প্রকাশিত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প থেকে শাখা ছাত্রলীগকে টাকা দেওয়ার অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল অনেক আগেই। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ক্যাম্পাসে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। প্রকল্পে দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে এলেও অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযোগকারীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম।

তবে এবার টাকা ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে শাখা ছাত্রলীগের এক নেতার ফোনালাপ ফাঁস হওয়ায় ফেঁসে যাচ্ছেন জাবি উপাচার্য। এতে স্পষ্টতই টাকা দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে কথা বলা জাবি ছাত্রলীগ নেতার পরিচয় এবং ফোনালাপ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে পাঁচটি নতুন আবাসিক হলের নির্মাণকাজ যাতে নির্বিঘ্নে হয় সে জন্য প্রকল্পের সেই টাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে এক কোটিসহ মোট দুই কোটি টাকা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয় ৯ আগস্ট উপাচার্যের বাসভবনে এ টাকা ছাত্রলীগকে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সময় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জুয়েল রানা, সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান চঞ্চলসহ পাঁচজন নেতা ও উপাচার্যের পরিবারের একাধিক সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই সংবাদে উপাচার্যের সঙ্গে টাকা ভাগের বৈঠকে যে চার ছাত্রলীগ নেতা উপস্থিত ছিলেন বলে প্রকাশ হয়েছিল ফোনালাপকারী এই ছাত্রলীগ নেতা তাদের মধ্যে একজন।

ফোনালাপের শুরুতে রাব্বানী জিজ্ঞেস করেন, ‘টাকা নেওয়ার সময় কে কে ছিল, টাকাটা দিছে কোন জায়গায় বইসা।’ জবাবে জাবি ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘ভাই আমি আপনারে বলছিলাম না যে, আমি (সাদ্দাম হোসেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) তাজ (নিয়ামুল হক তাজ-সহসভাপতি), জুয়েল (সভাপতি), চঞ্চল (সাধারণ সম্পাদক) ছিলাম ওই মিটিংয়ের সময়।’

নিচে তাদের কথোপকথন

রাব্বানী : ম্যাম তো বলছে এ আন্দোলনও নাকি আমরা করাইছি! আন্দোলন কারা করছে সেটাও তো আমরা জানি না।

সাদ্দাম হোসেন : বিষয়টা হচ্ছে উনি ছাত্রলীগের ওপর সবকিছু দিয়া নিজের ফ্যামিলিরে সেভ করতে চাচ্ছে।

রাব্বানী : আচ্ছা যখন টাকাটা দিছে তখন তুই ছিলি না?

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ ভাই আমি ছিলাম।

রাব্বানী : টাকাটা দিছে কীভাবে, ম্যাম নিজেই দিছে, অন্য কেউ ছিল না?

সাদ্দাম হোসেন : ওখানে হচ্ছে ভাই আর কেউই ছিল না। ম্যাম এবং তার পরিবার হচ্ছে আমাদের সঙ্গে ডিলিংসটা করছে। করে সে হচ্ছে টাকাটা আমাদের হলে পৌঁছে দিছে।

রাব্বানী : হলে পৌঁছে দিছে টাকা?

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা গাড়িতে করে এক লোক এসে দিয়ে গেছে।

রাব্বানী : কয় টাকা দিছে?

সাদ্দাম হোসেন : আমাদের বলছে এক কোটি। আমরা বাকিটা জানি না, জুয়েল আর চঞ্চলের সঙ্গে আলাদা সিটিং হইতে পারে।

রাব্বানী : আমি শুনলাম এক কোটি ষাট।

সাদ্দাম হোসেন : ওইটা ভাই ষাইটেরটা আমরা জানি না। উনি এক কোটি ভাগ করে দিছে। যে পঞ্চাশ হচ্ছে জুয়েলের, পঁচিশ আমাদের আর পঁচিশ চঞ্চলের।

রাব্বানী : ও ম্যাডাম এভাবে ভাগ করে দিছে? জুয়েল ভালো ছেলে এ জন্য পঞ্চাশ আর চঞ্চল ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে এ জন্য পঁচিশ?

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ। চঞ্চল আমাদের তো বাদ দিতে পারে নাই। ঝামেলা এড়ানোর জন্য বা..

রাব্বানী : ও চঞ্চলের ভাগেরটাই তোরা পাইছস?

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ, চঞ্চলের ওখান থেকেই, আমরা বলছি যে ২৫% আমাদের দেওয়া লাগবে। তারা হচ্ছে ভাই তাহলে আমাদের না জানায়া তাদের আলাদা ষাট লাখ টাকা দিছে, এটা হইতে পারে।

রাব্বানী : ও তাহলে তোদের না জানায়া দিছে?

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা এটা জানি না আমরা এক কোটির হিসাব জানি।

রাব্বানী : তোমার ম্যাডাম যে আমাদের নাম জড়াইল এখানে, টাকার ব্যাপারে আমার বা শোভনের কোনো আইডিয়াই তো নাই।

সাদ্দাম হোসেন : ভাই উনি খুব নোংরামি করতেছে। আপনারা ভাই সিদ্ধান্ত নেন আমাদের কি করা লাগবে আমরা সেটা করতেছি।

রাব্বানী : আমিও বুঝতেছি নিজে সেভ হওয়ার জন্য ফ্যামিলি সেভ করার জন্য। এ ছয়টা কাজ বেসিক্যালি ঠিকাদারদের সঙ্গে ডিল করছে কে?

সাদ্দাম হোসেন : ভাই মূলত ডিলটিল করছে তার ছেলে, তার পিএস সানোয়ার ভাই, আর পিডি (নাসির উদ্দিন) আর তার স্বামী-এ চারজন।

রাব্বানী : হাজবেন্ড-ছেলে পিডি নাসির আর পিএস সানোয়ার? ও তারাই আগে থেকে ছয়টা কোম্পানি ঠিক করে রেখেছে?

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ, শুরু থেকেই তারা সবকিছু করছে।

রাব্বানী : টেকনিক্যাল কমিটিতেও ভিসি ছিল? ভিসি তো থাকতে পারে না।

সাদ্দাম হোসেন : হ্যাঁ সে ছিল। প্রথমত সে তো সবাইরে ফেরত-টেরত পাঠায়া দিল না! শিডিউল ছিনায়া-টিনায়া নিচ্ছিল। পরে হচ্ছে আমরা বলছি সবাইরে কিনতে দিতে হবে সবাইরেই ড্রপ করতে দিতে হবে। তখন হচ্ছে ড্রপ সবাইরেই করাইছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে নিজ হাতে সব বিষয়গুলো করছে। উপাচার্যের হাসপাতালে ভর্তি নাটক ছিল যাতে তাকে কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে।

পরে আবার কথা বলবেন বলে রাব্বানী ফোনালাপ শেষ করেন।

ফোনালাপে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাবি ছাত্রলীগ ওই নেতা সাদ্দাম হোসেন (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) বলেন, ‘গোলাম রাব্বানী ভাই সাধারণ সম্পাদক ছিল কেন্দ্রের আমি তার রাজনীতি করতাম এখন ভাইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সে যা বলছে তাই বলছি সে যা করতে বলছে তাই করছি। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছে আমিও ওই ভাবে কথা বলছি।’

তিনি টাকার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘টাকার যে বিষয়টা হচ্ছে আমিও নিজেও গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানছি।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থেকে ছয় শতাংশ চাঁদা দাবিসহ অন্যান্য অভিযোগে গত শনিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারান গোলাম রাব্বানী। একই অভিযোগে পদ হারান সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনও।

এর আগে গত শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) উপাচার্য ফারজানা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট গল্প। একেবারে বানোয়াট। আর তদন্ত করলে, অনুসন্ধান করলে জানা যাবে এ ধরনের কিছু হয়েছে কি না।’

এ ছাড়া শনিবার রাতে এক বিবৃবতিতে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে ‘অর্থলোলুপ’ আখ্যা দিয়ে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের একাংশের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’। আবার উপাচার্যপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’ বিবৃতির মাধ্যমে দাবি করে উপাচার্য ‘অর্থলোলুপ’ নন বরং তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।

দীর্ঘ এ আন্দোলনে এর আগে উপাচার্যে পদত্যাগ দাবি না করলেও এবার অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে পদত্যাগ দাবি করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজে’র শিক্ষকরা।

বিবৃতিতে শিক্ষকরা বলেন, ‘উপাচার্য ও তার পরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে’র টাকা ভাগাভাগির সংবাদ এখন সারা দেশের সবচেয়ে আলোচিত সংবাদ। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা লুটপাটের ঘটনায় দেশের প্রথম নারী উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে অনেকের মনে কিঞ্চিৎ সংশয় থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ‘খোলা চিঠি’ নিশ্চিত বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। এ অবস্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত এই উপাচার্যের আর স্বপদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads