• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

রাজনীতি

অর্জন বিসর্জনে ছাত্রলীগ

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০১৯

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১১ বছরে অনেক সূচকে উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। তবে সরকারের উন্নয়নকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে ক্ষমতাসীনদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটি নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে। বেপরোয়া হয়ে ওঠা ছাত্রলীগের বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হওয়া থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাও যেন সরতে চাচ্ছেন না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা বারবার অস্থির করে তুলছেন দেশের শিক্ষাঙ্গন। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষাঙ্গনের ক্যাম্পাস থেকে নানা অঙ্গনে। কঠোর নির্দেশ, কখনো কখনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা ও কিছু ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নিয়েও ছাত্রলীগের বর্বর ঘটনা থামানো যাচ্ছে না।

চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, মাদকসেবন, পদবাণিজ্য আর নির্মাণকাজ থেকে কমিশন দাবিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের ওই সময়ের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বহুল আলোচিত ক্যাসিনো, জুয়া ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে যুবলীগ, কৃষক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগেও সংস্কার ও আরো জোরালো শুদ্ধি অভিযানের আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে ফেসবুকে ভিন্নমত প্রকাশের অভিযোগে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে গণমাধ্যমের নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দেশব্যাপী শান্তিকামী মানুষের ঘৃণা বর্ষিত হচ্ছে তাদের উদ্দেশে।

ছাত্রলীগের একের পর এক নেতিবাচক ঘটনায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। সংগঠনটির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম সরকারি দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেককেই ‘অবাক’ করছে। সংগঠনের নেতাকর্মীদের একের পর এক বেপরোয়া কর্মকাণ্ড নানা বিতর্কের জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন সংগঠনটির ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করছে। নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ ও পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কার্যকলাপের কারণে প্রায় নিয়মিতই আলোচনায় থাকছে সংগঠনটি। এতে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের পাশাপাশি সরকারের অনেক অর্জনও বিসর্জনের পথে হারিয়ে যেতে বসেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় সন্ত্রাসী ঘটনার পুুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং সরকারের নানা অর্জনও ছাত্রলীগের নেতিবাচক ঘটনায় আড়ালে পড়ে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সবাই ভালো, তা বলা যায় না। নানা কারণে আগাছা-পরগাছা দলে অনুপ্রবেশ করেছে। ছাত্রলীগ অনেক ভালো কাজও করেছে। চাঁদের গায়েও খুঁত আছে। তবে গুটিকয়েক লোকের কারণে আওয়ামী লীগের বা ছাত্রলীগের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে না।’

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ফেসবুকে কোনো একটা মত প্রকাশের কারণে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে মেরে ফেলা হয়ে থাকলে তা খুবই হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তাহলে আর কী বাকি থাকল? ছাত্রলীগ এখন যা করছে এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের দুর্নীতি বের হচ্ছে, অন্যদিকে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা নৃশংসতা করছে। আমরা তো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। এভাবে তো চলতে পারে না।’

তথ্যমতে, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়েই ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনটির সাংগঠনিক নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদেরও ছাত্রলীগ নেতাদের সতর্কও করেছেন বহুবার। সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েও বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা করেন তিনি। গত প্রায় ১১ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকারের আমলে ছাত্রলীগের অনেক ইতিবাচক কাজ ও অর্জন থাকলেও কিছু কিছু নেতাকর্মীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটি এখন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। সংগঠনটির একশ্রেণির নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করলে হত্যা, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির চিত্র ভেসে ওঠে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। গত ১১ বছরে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মীরা করেননি। প্রায় ১১ বছর ধরে ছাত্রলীগ মূলত আলোচনায় এসেছে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই কিংবা টেন্ডারবাজির কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে খুনোখুনিসহ নানা অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির তেমন নেই বলেও অভিযোগ আছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন দাবি, টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেওয়া, অবৈধভাবে ক্ষমতা প্রদর্শনসহ নানা অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে আল নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন নেতৃত্ব আসার পরও থামেনি ছাত্রলীগের অপরাধকর্ম।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ড খুবই দুঃখজনক। কেউ ভিন্নমতাবলম্বী হলেও তাকে মেরে ফেলা যায় না। এ ঘটনায় ৫ মিনিটের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কয়েকজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে। অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধীদের শাস্তি পেতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে অপরাধ করে কেউ ছাড় পায়নি, পাবেও না।’

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ছাত্রলীগের বিতর্কিত ঘটনায় স্পষ্ট যে, মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যের রাশ টানতে পারছে না ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও অভিভাবক রাজনৈতিক দল। ছাত্রলীগের এসব সহিংসতার কারণ হিসেবে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার, ভর্তি বাণিজ্য কিংবা দলীয় কোন্দলকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণগুলো চিহ্নিত হওয়ার পরও কেন ছাত্রলীগের রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না-এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী নেতৃত্বের পক্ষ থেকে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপরাধী যে দলের পরিচয়ধারীই হোক, তাকে ছাড় না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসবের কোনো প্রতিফলন নেই। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের তাণ্ডব ও সন্ত্রাস পুলিশ দেখেও দেখে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও তাদের ঘাটাতে চায় না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads