• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
হঠাৎ অস্বস্তিতে সরকার

ফাইল ছবি

রাজনীতি

হঠাৎ অস্বস্তিতে সরকার

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ১২ অক্টোবর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। তার এবারের ভারত সফরে দেশের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ করে রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। দুই দেশের সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ও কূটনৈতিক অঙ্গনেও আলোচনার রেশ কাটেনি। এরই মধ্যে সফরে হওয়া চুক্তিগুলোর সমালোচনা করে বুয়েটের এক শিক্ষার্থী ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় ও ভিন্নমত প্রকাশ করায় নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশ। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সরকারের সব চুক্তিকে ‘দেশের পক্ষে হানিকর’ দেখানোর পরিকল্পনায় সরকারবিরোধী কোনো পক্ষ মাঠে নেমেছে কি না-এ প্রশ্নও উঠছে।  

শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ক্ষুব্ধ সারা দেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও কঠোর বক্তৃতা বিবৃতিতে সরব। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, সমালোচনা আসছে দেশের বাইরে থেকেও। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতার জেরে ছাত্রলীগের হাতে বুয়েট শিক্ষার্থী হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘও। হঠাৎ সৃষ্ট এ পরিস্থিতিতে সরকার এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। 

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ভারত সফরে ‘দেশের স্বার্থ হানিকর সব চুক্তি’ করেছে বলে দাবি করছে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। সরকারের সমালোচনা করে দলটি বলছে, ‘এসব চুক্তি নিজ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে শক্তিমান প্রতিবেশীকে খুশি করে ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার সাময়িক ও ব্যর্থ চেষ্টামাত্র।’  

আওয়ামী লীগের দাবি, দলটি বরাবরের মতোই অন্ধ ভারত বিরোধিতা থেকে এসব সমালোচনা করছে। ভারতবিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও শক্তিগুলো এসব ইস্যুকে কেন্দ্র করে মাঠে নেমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে কোনো ষড়যন্ত্র করছে কি না-এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন  

সরকারের নীতিনির্ধারকরা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় ভারতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আজকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। স্বার্থান্বেষী মহল চুক্তিগুলো না পড়েই সরকারের সমালোচনা ও ভারত বিরোধিতা করছে বলেও তাদের দাবি। 

সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী, বরাবরের মতোই এ হিসাব-নিকাশ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতে প্রধানমন্ত্রীর চার দিনের সফরে সাতটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। যেসব চুক্তি হয়েছে, সেগুলো ভালো। তবে সেগুলোতে বাংলাদেশের তেমন প্রাপ্তি দেখছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের দাবি, এবারো ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো ফেনী নদীর পানি তুলবে ভারত। তবে ফেনী নদীর পানি ভাগাভাগির ফলে বাংলাদেশের ওপর ভারতের নির্ভরতা বেড়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্ক আরো মজবুত করে তুলেছে বলে দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, রোহিঙ্গা ইস্যুতেও শক্তভাবে বাংলাদেশের পাশে ভারতের থাকার প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যায়নি। ভারতীয় জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন না হতে আশ্বস্ত করলেও ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষ নেতারা প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছেন, অবৈধ ‘বাংলাদেশিদের’ ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এসব বিষয়ে স্পষ্ট সুরাহা হওয়া দরকার বলেও দাবি কোনো কোনো আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকের। বিষয়গুলো নিয়ে তাই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ সরকারের সমালোচনাও করছেন। 

তবে সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে মনে করিয়ে দেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশের সরকার যে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিল, কবে তার বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের জনগণ অধির আগ্রহে সেই অপেক্ষায় আছে।’ যৌথ বিবৃতিতে আরো জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি জবাবে বলেন, ‘তার সরকার তিস্তায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেছে, যাতে যতদ্রুত সম্ভব একটি তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করা যায়।’ 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের। একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি। ফলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পানি সংকট চলছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টনের আলোচনা ও চুক্তির বিষয়ে অগ্রগতি হয়। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি চুক্তি সই হওয়ার কথা প্রায় চূড়ান্ত ছিল।  

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন ঢাকায় আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসেননি, ফলে তিস্তা চুক্তিও তাই হয়নি। পরে ২০১৫ সালে ঢাকা সফরকালে তিস্তার পানি দেওয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন মমতা। পরিবর্তে তিনি তোর্শা নদীর পানিবণ্টনের প্রস্তাব দেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, তিস্তার পানিবণ্টনে চুক্তির বিষয়টিকে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে অনেক দূর এগিয়ে নিলেও শেষ পর্যন্ত মমতার বিরোধিতার কারণে তখন চুক্তি হয়নি। যা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। 

সূত্রমতে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত সাস্প্রতিক চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ বাহারুল আলমকে দল থেকে গত বুধবার সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার স্ট্যাটাসটির শিরোনাম—‘ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বলা হলেও বাস্তবে একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ ও অধিকার চরম উপেক্ষিত’। ওই স্ট্যাটাসের কারণে তাকে কেন দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, সাত দিনের মধ্যে এর কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। ৯ অক্টোবর খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ফরিদ আহমেদের গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বাহারুলকে দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার ও কারণ দর্শাতে বলার বিষয়টি জানানো হয়। 

কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্প্রতি কিছু চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, স্ট্যাটাসের জের ধরে ডা. বাহারুলকে দল থেকে বহিষ্কার করার ঘটনায় এর এক ধরনের ‘যৌক্তিকতা’ তৈরি হলো। বাহারুল বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) খুলনা শাখার সভাপতি।  

গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত দল থেকে বহিষ্কারের আনুষ্ঠানিক কোনো কাগজ বা চিঠি পাইনি। দল সম্পর্কে কোনো কথাই আমি স্ট্যাটাসে লিখিনি। ভারত যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে অগ্রাহ্য করছে, সেটা আমি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে সমালোচনা করেছি।’ 

শীর্ষ পর্যায়ের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আবরার ফাহাদের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবির। এ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ভয়াবহ নাশকতার চক্রান্ত শুরু করেছে সংগঠনটি। তিন দিন ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে পুঁজি করে মাঠে আছে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ও বিভাগীয় শহর রংপুরে মিছিল করে শক্তি জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে শিবির। মিছিলে বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ স্লোগান ব্যবহার করে সরকার পতনের হুমকি দিয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দিয়ে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে’ ছাত্র শিবিরের বিভিন্ন কর্মীরা। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads