• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

রাজনীতি

নিরাপদ আশ্রয়ে বড় দলের সুবিধাবাদী ও বঞ্চিতরা

লক্ষ্য ‘জাতীয় সরকার’

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০১৯

মাঠে-ময়দানে টানাটানিতে রাজনীতির কথামালা দীর্ঘ হচ্ছে। আবার মাঝেমধ্যে ছিঁড়েও যাচ্ছে সে মালা। সময় সময়ে মেরূকরণ ঘটে রাজনীতিতে। সরকার মাত্র এক বছর পার করেছে। বাকি চার বছরজুড়ে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা তাদের চিন্তায়। এদিকে বিপর্যস্ত বিএনপিকে ‘আতশকাচ’ দিয়ে দেখলেও দলটির ভবিষ্যৎ রেখা খুবই ক্ষীণ। বামপন্থিদের আশার দূরত্ব যোজন যোজন। এরই ফাঁকে সুদূরপ্রসারী বিশেষ পরিকল্পনা থেকে সাবেক বেসামরিক কর্মকর্তা কিংবা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের চেম্বারে, বাসাবাড়িতে বৈঠকও হচ্ছে। কড়াভাবে কষা হচ্ছে শাসনক্ষমতার জটিল হিসাব। সে হিসাবের খতিয়ানে থাকতে বৃহৎ একাধিক দলের প্রভাবশালী নেতারা এখনোই নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। শুরুটা করেছেন রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি নেতারা। গত এক যুগে দলটির ডজন নেতা বিএনপি ত্যাগ করেছেন। এলডিপি, বিকল্পধারা, জাসদসহ বেশ কয়েকটি দল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালী নেতারা। কেউ কেউ ছোট-খাটো দলের ব্যানারে সক্রিয় আছেন। শাসক দলের মন্ত্রিত্ব কিংবা পদবঞ্চিত নেতারা আছেন ঘাপটি মেরে। উল্লিখিতরা প্রহর গুনছেন ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র জন্য। তাদের টার্গেট ওয়ান ইলেভেনের আদলে ভিন্ন মোড়কে ‘জাতীয় সরকার’।

ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা আ স ম আবদুর রব তো ইতোমধ্যে ওই সরকারের রূপরেখাও দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরাও শুনছি এ ধরনের একটি সরকারের কথা। পর্যবেক্ষণও করছি। কিন্তু কথা হলো, এ জাতীয় সরকার এসেছে রুলিং পার্টিগুলো সংকট দূর করার জন্য। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখেছি, ওয়ান-ইলেভেনের সরকার দেখেছি। তাতে দুই দলের সংকট দূর হয়েছে, অপরাধের শাস্তি থেকে থেকে দূরত্ব রক্ষা করতে পেরেছে কিন্তু জনগণের কোনো কল্যাণ হয়নি। ভবিষ্যতেও আসবে না বলে মনে করেন এই বামপন্থি নেতা। 

বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘গুমোট’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা কয় বছর আগেও দেখেছি, দুই দলের কিছু নেতা ‘একটা কিছু’ করতে চান। কখনো ‘সংস্কার’ কখনো ‘ভিন্ন কিছু’ নামে দুই মেরুর লোকজন একত্র হতে চান। এখনো সে তৎপরতা চলছে। কিন্তু এটা আপাতত সম্ভবপর নয় বলে মনে করেন ড. দিলারা।

তিনি বলেন, এ দেশের রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই, দেশের পরিচালক নির্বাচিত করার ক্ষমতাও জনগণের কাছে নেই। ফলে তারা (আমি নাম বলছি না) যাকে যত দিন চাইবে তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। দেশে বড় ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা না ঘটলে আপাতত উল্লিখিত প্রভাবশালী নেতাদের আশা পূরণ হবে না। 

এদিকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ত্যাগের আগে স্থানীয় মিশনে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, দেশে ১/১১ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তার সরকার কঠোরভাবে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। তিনি বলেন, যদি কোনো অন্যায় কিছু হয়, কে করেছে, সেটা দেখা হবে না। এমনকি আমার দলের লোক হলেও আমি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। শুদ্ধি অভিযান নিজ বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত। কিছু মানুষ আছে, যারা ধনসম্পদ দেখাতে (শোয়িং অফ) অভ্যস্ত, যা তারা হঠাৎ করে পেয়েছে। সমাজের এই শ্রেণির লোকদের একটা ধাক্কা দেওয়া প্রয়োজন। তখন দেশে শুদ্ধি অভিযান চলছিল। তার দলের অনেক নেতাই এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

বিএনপির রাজনীতি ঘিরে নতুন একটি তৎপরতার গুঞ্জন ধীরে ধীরে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলটির সিনিয়র পর্যায়ের মুষ্টিমেয় কিছু নেতার মধ্যে চেষ্টা চলছে ‘বিকল্প চিন্তা’ ঢুকিয়ে দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে সুকৌশলে দলটির বর্তমান নেতৃত্বে ‘রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব নয়’ এমন একটি অনাস্থার ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে ওইসব নেতার নেতৃত্বে নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা সম্ভব হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন সহসা মুক্তি না পেলে এই ধরনের তৎপরতা একটি পর্যায়ে গিয়ে বাস্তবে রূপ নিতে পারে বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে।

গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার কারাবন্দির পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে দলটি পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তারেক রহমানও রয়েছেন লন্ডনে। দলে কিংবা রাজনীতিতে এই দুই শীর্ষ নেতার সরাসরি অনুপস্থিতিকে একটি মহল ‘নেতৃত্বের সংকট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এর অংশ হিসেবে নতুন এই তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে কেউ কেউ বলছেন।

রাজনৈতিক সূত্র বলছে, বিএনপির সিনিয়র পর্যায়ের হতাশ কিছু নেতাকে এ ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয়েছে। যারা দীর্ঘ সময় ধরে দলীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার জন্য মাঝেমধ্যে একত্রে বসছেন। কোনো প্ল্যাটফর্ম গঠনের কথা তারা আলোচনায় না আনলেও দলীয় রাজনীতি নিয়ে নানা হতাশার কথা তুলে ধরছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিষয়টি সাপোর্টও করছেন। তবে এই তৎপরতার সঙ্গে যুক্তরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন বলেও মনে করা হচ্ছে। দীর্ঘ এই সময়ে কিংবা এরও আগে প্রভাবশালী কিছু নেতার বিএনপি ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন দল গঠন কিংবা অন্য কোনো দলে যুক্ত হওয়াকে ওই মহলটি সফলতা হিসেবে দেখছেন। যেটি ভবিষ্যতেও চলবে বলে তারা মনে করেন।

একটি সূত্র বলছে, আগামী দিনে যেকোনো সময় একটি ‘জাতীয় সরকার’ গঠিত হতে পারে, এমন একটি ধারণাও কোনো কোনো রাজনীতিবিদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএনপি থেকে সাম্প্রতিক সময়ে দুইজন নেতা পদত্যাগ করেছেন। তাদের মধ্যে একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান, অন্যজন ভাইস চেয়ারম্যান এম মোর্শেদ খান। দুইজনই ব্যক্তিগত ও বয়সের কারণে পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন। যদিও বিএনপির মাঠপর্যাযের নেতাকর্মীরা এই কারণকে বিশ্বাস করতে চান না। তারা কোনো অদৃশ্য চাপ কিংবা ব্যবসায় বাণিজ্য রক্ষায় পদত্যাগ করেছেন বলে তারা মনে করেন।

জানা গেছে, আপাতত দলেই থাকতে হচ্ছে বিএনপির পদত্যাগকারী নেতাদের। কারণ তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না-করা বিষয়ে এখনো দল থেকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এসব নেতার পদত্যাগের বিষয়ে এখনোই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না দল। পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চায় দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম। তবে পদত্যাগী নেতাদের দল ছাড়ার কারণ অনুসন্ধান শুরু করেছে বিএনপি।

একাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন উপদেষ্টা পরিষদে থাকা সিলেটের ইনাম আহম্মেদ চৌধুরী। ‘খালেদা জিয়াবিহীন বিএনপিতে যারা পরিচালকের আসনে আছেন, তাদের সঙ্গে আর যাই হোক রাজনীতি করা যাবে না’—এমন অভিযোগ এনে দলত্যাগ করেছেন তিনি। ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী দল থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, সম্পূর্ণ শারীরিক কারণে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে পদত্যাগের পরের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে বিএনপি এখন অনেকটাই দূরে। ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী ফালু। নির্বাহী কমিটির আরো বেশ কয়েকজন নেতা বিগত কাউন্সিলের পর নানা কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাদের কারো বিষয়েই এখনো পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বিএনপি।

এলডিপির কিছু নেতা পদত্যাগ করেছেন। গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে দলের মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ উল্লেখ করেছেন, তার দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে সাবেক তিনজন এমপি দল ত্যাগ করেছেন। এদিকে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টির কয়েক নেতা দল ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আরো বাম কয়েকটি দলেও দেখা দিয়েছে দলছুটের প্রাথমিক ঘটনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads