• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
পদ হারাচ্ছেন মনিব, চাকর হচ্ছেন নেতা

ছবি : ‍সংগৃহীত

রাজনীতি

পদ হারাচ্ছেন মনিব, চাকর হচ্ছেন নেতা

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯

নেতাদের ভাষ্য, দলীয় প্রধানের অবর্তমানে কমিটি গঠন নিয়ে কী হচ্ছে না? কমিটি গঠনের জন্য যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা দুর্দিনেও পদবাণিজ্য করেছেন। অনিয়ম ধরতে যাদের নিয়োজিত রাখা হয়েছে তারাই নিজ বলয়ের কর্মীকে নেতা বানাচ্ছেন, আবার ছোট নেতাকে বড় নেতা বানানোর সুপারিশও করছেন। কোনো কোনো এলাকায় ব্যক্তিগত ক্রোধ মেটাতে কমিটি ভাঙা-গড়া হচ্ছে। সুবিধা নিয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের অভিযোগের ফাইলও বাড়ছে। এমন ঘটনাচক্রের ধারাবাহিকতায় চাকর হচ্ছেন নেতা আর পদ হারাচ্ছেন মনিব। বড় নেতার মন খুশি না করলে কপাল পুড়ছে অনেক ছোট নেতানেত্রীর। এ চিত্র দীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল বিএনপির। কেন্দ্র থেকে মাঠপর্যায়ের এ অবস্থার ফাঁকে বিএনপিতে প্রবেশ করছেন শরিক দল জামায়াতের নেতাকর্মীরাও।

কমিটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এ প্রতিবেদককে জানান, তারা ত্রিমুখী চাপে আছেন। দলের হাইকমান্ড দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি গঠনের চাপ দিচ্ছেন। দলের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠনের দাবি করছেন সাধারণ নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে সিনিয়র ও প্রভাবশালী নেতারা নিজের বলয় সৃষ্টি করার মতো কমিটি গঠনের চাপ দিচ্ছেন। সবাইকে খুশি করার মতো কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। যে কারণে বেঁধে দেওয়া সময়ের  মাস-বছর পার হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিএনপিসহ অঙ্গ দলগুলোর কমিটি গঠনের জন্য সময় বেঁধে দিয়ে যাদেরই এ পর্যন্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের কেউ নির্দিষ্ট সময়ে কমিটি করতে সক্ষম হয়নি। মূলত স্বজনপ্রীতি, পদবাণিজ্য, সিনিয়র নেতাদের অন্যায় আবদার, প্রভাব খাটিয়ে গুটি কয়েকদের সুবিধা দেওয়া, বিশেষ কোনো নেতাকে চাপে রাখা, নিজের বলয় সৃষ্টি করাসহ নানা কারণেই কমিট গঠন বিলম্ব হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে স্বাধীনভাবে কমিটি গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুতে হাইকমান্ডের কাছে দাবি জানিয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেন। এসব নেতা প্রথমে কিছুটা নিরপেক্ষ থেকে কাজ করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক টিমের বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, প্রভাব খাটিয়ে কিছু নেতাকে সুবিধা দেওয়া, বিশেষ কোনো নেতাকে চাপে রাখা, নিজের বলয় সৃষ্টিসহ নানা অভিযোগ ওঠে। দলের হাইকমান্ডও এসব অভিযোগের ভিত্তিতে একাধিক টিম গঠন করেন। ওই টিম মাঠে কাজ করছে। এরই মধ্যে কোনো কোনো টিম তাদের প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে।

জানা যায়, অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীনকে প্রথমে সতর্ক করা হয়। একই সঙ্গে পিরোজপুর জেলা বিএনপির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে শিরিনসহ তার টিমকে প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীতে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো বরিশাল বিভাগে শিরিনকে দল পুনর্গঠনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুুল আউয়াল মিন্টুকে দল পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একইভাবে ময়মনসিংহ বিভাগেও কমিটি গঠন নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।

ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর কমিটি জমা দেওয়ার পরও সেটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। সেখানেও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির সূত্রমতে, ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ১৯টিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্বশীল নেতাদের তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। নির্ধারিত সময়ে অধিকাংশ জেলাই পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি।

এদিকে ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের আংশিক কমিটিও পূর্ণাঙ্গ করতে হিমশিম খাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। ঢাকার  উত্তর ও দক্ষিণ দুটি এবং এই দুটি অঙ্গদলের আংশিক কমিটিকে নির্ধারিত সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে কয়েক দফা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও কমিটি করতে পারেনি তারা।

ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান বলেন, কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের চাপ থাকবে এটা অস্বাভিবক নয়। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করা খুবই কঠিন কাজ। দীর্ঘ ২৫ বছরে কমিটি হয়নি এমন থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে বর্তমান আংশিক কমিটি সক্ষম হয়েছে। সব ধরনের চাপ উপেক্ষা করে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটিও করা সম্ভব হবে।

ঢাকা মহানগর কমিটির বাইরে আন্দোলন সফলের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনেও রয়েছে প্রচণ্ড চাপ। আংশিক কমিটি নিয়েই গত ২৭ অক্টোবর কমিটির তিন বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দলের। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এখন ‘অবৈধ’। আর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি আর সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের যুবদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এক মাসের সময়সীমা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় অনুমোদনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির পাশাপাশি শীর্ষ নেতৃত্বে মতপার্থক্যে এবং নানামুখী চাপে ২ বছর ১০ মাসেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, এক মাসের বেঁধে দেওয়া সময়ে হয়তো কমিটি গঠন সম্ভব ছিল। কিন্তু এই দায়িত্ব যেন হাত বেঁধে সাঁতার কাটতে দেওয়ার মতো। নেতাকর্মীরা চান যোগ্য ও ত্যাগী নেতাকে কমিটিতে আনতে।

অন্যদিকে সিনিয়র নেতারা তাদের পছন্দমতো নেতা নির্বাচন না করলে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। অনেক সময় হাইকমান্ডের কাছে পর্যন্ত তদবির যায়। না করলে নিজের পদ রাখাটা হুমকির মুখে পড়ার উপক্রম হয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যিকারের যোগ্য নেতাকে পদ দেওয়া যায় না। দিতে হয় অযোগ্যদের। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

যুবদল সূত্র জানায়, গত ২ বছর ১০ মাস ধরে সিনিয়র নেতাদের প্রচণ্ড চাপের পরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। ২৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকাও প্রস্তুত হয়। কিন্তু দলের প্রভাবশালী এক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের তদবিরে একটি পদ নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দেয়। প্রভাবশালী ওই সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক রাজাকার কমান্ডার পলাতক ফাঁসির আসামি জাহিদ হোসেন খোকনের বড় ছেলে খায়রুজ্জামান লিংকনকে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সুপার ফাইভের সব নেতা রাজাকার পুত্রের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি মেনে নেননি। ফলে কমিটি ঘোষণার বিষয়টি থমকে যায়।

এ নিয়ে যুবদলের সুপার ফাইভের এক নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, এক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদের নেতার চাপে কমিটি গঠন আটকে গেলে স্থায়ী কমিটির নেতার চাপে কি হতে পারে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু কথা বলার সময় সবার এক কথা দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনো কাজ করেন না। এরপরও শিগগির কমিটি ঘোষণা করা সম্ভব হবে বলে দাবি করেন এই যুবনেতা। যুবদল স্বেচ্ছাসেবক দল ছাড়াও ৩ মাসের মধ্যে কাউন্সিল করে নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য চার সংগঠনকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা করতে পারেননি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অঙ্গ সংগঠনগুলো হলো- কৃষক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল ও মৎস্যজীবী দল। এ চারটি সংগঠনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে এখন আবার ‘পর্যবেক্ষণ কমিটি’ করেছে বিএনপি। সেই পর্যবেক্ষণ কমিটির কোনো কোনো নেতাকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।

মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস ও সাধারণ সম্পাদক সুলতানা গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সম্প্রতি মারামারির ঘটনা ঘটেছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। দলের নারী নেত্রী জেবা খান লাঞ্ছিত হয়েছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হাতে। এ ঘটনা জানার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মহিলা দলকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিষিদ্ধ করেছেন।

ময়মনসিংহের সাবেক এমপি মহিলা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি নূরজাহান ইয়াসমিনের বাসায় কাজের ‘ঝি’-এর কাজ করতেন আজিজুন্নাহার আজি। স্বশিক্ষিত আজিই এখন ময়মনসিংহ জেলা মহিলা দলের সহদপ্তর সম্পাদক। আজির স্থান গুরুত্বপূর্ণ পদে হলেও মহানগর মহিলা দলের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত ডা. হাদীর কন্যা হাসনা হাদীর নির্বাহী কমিটিতে স্থান জোটেনি। তরুণনির্ভর কমিটি করার কথা বলা হলেও ৭০ বছর বয়সী নারী নাজনীন মাহমুদকে প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

এই পদ পেতে সভাপতি আফরোজা আব্বাসের মিডিয়া উইংয়ে তৎকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত জাহাঙ্গীর আলম মিন্টুর মাধ্যমে চার লাখ টাকা উৎকোচ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকজন মহিলা দল নেত্রী কারাবন্দি হন। তাদের পরিবারের সহযোগিতার  জন্য ৬০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই উত্তোলনকৃত টাকার হদিস মিলছে না। অতীতে জেলা বা কেন্দ্রে কোনো কমিটিতে ছিলেন না আড়াইহাজার থানায় বসবাসকারী পারভীন। তাকে দেওয়া হয়েছে মহিলা দলের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ।    

বিএনপির পুনর্গঠনের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ প্রতিবেদককে বলেন, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। কোথাও কোনো অভিযোগ থাকলে তা দেখতে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে একাধিক টিম কাজ করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads