• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

রাজনীতি

ফের বেপরোয়া ছাত্রলীগ

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি ২০২০

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট উৎসবে যখন মুখরিত চারপাশ, তখনো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার মতো ঢাবির চার শিক্ষার্থীকে ‘শিবির সন্দেহে’ পিটিয়ে আবারো প্রবল সমালোচনা ও আতঙ্কের জন্ম দিল সংগঠনটি।

শুধু ঢাবিতেই নয়, চট্টগ্রাম ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল ও প্রভাব বিস্তারে সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীরা এই মুহূর্তে নেতিবাচক সংবাদেরই শিরোনাম। তাদের অপকর্মের দায়ে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে চলছে অস্থিরতা ও উত্তেজনা। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরাও চরম ক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষাঙ্গনের ক্যাম্পাস থেকে নানা অঙ্গনে।

অভিযোগ উঠেছে, দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না ‘লাগামহীন’ হয়ে পড়া সংগঠনটিকে। নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হওয়া থেকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এক শ্রেণির নেতাকর্মীও যেন সরতে চাচ্ছেন না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ভিন্নমতের ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা বারবার অস্থির করে তুলছেন দেশের শিক্ষাঙ্গন। মূল দলের কঠোর নির্দেশ, কখনো কখনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা, বিতর্কিতদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া  এবং কিছু ক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ নিয়েও ছাত্রলীগের বিতকির্ত ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের একের পর এক নেতিবাচক ঘটনায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সংগঠনটির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম সরকারি দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অনেককেই অবাক করছে। সংগঠনের বেপরোয়া ঘটনা নানা বিতর্ক জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও সরকারকেও বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি করছে। দেশের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন সংগঠনটির ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করছে। নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অপহরণ ও ধর্ষণসহ নানা কার্যকলাপের কারণে প্রায় নিয়মিতই আলোচনায় থাকছে সংগঠনটি।’

ওই দুই নেতার মতে, ‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের পাশাপাশি সরকারের অনেক অর্জনও বিসর্জনের পথে হারিয়ে যেতে বসেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় সন্ত্রাসী ঘটনার পুুনরাবৃত্তি হচ্ছে এবং সরকারের  নানা অর্জনও ছাত্রলীগের নেতিবাচক ঘটনায় আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।’

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাতে ঢাবির শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ‘শিবির সন্দেহে’ প্রথমে হল সংসদের কক্ষে, এরপর হলের ছাদে ও সর্বশেষ হলের অতিথিকক্ষে চার শিক্ষার্থীকে পেটান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ব্যবহার করা হয় হাতুড়ি আর ডিশের তার। শেষমেশ আবাসিক শিক্ষককে ডেকে পুলিশে দেওয়া হয় চার শিক্ষার্থীকে। অভিযোগ, ওই চারজন ‘ছাত্রশিবিরের’ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে প্রায় ১১ ঘণ্টা ঢাকার শাহবাগ থানার হাজতে রাখার পর পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে। একই ‘কায়দায়’ বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ফেসবুকে ভিন্নমত প্রকাশের অভিযোগে ‘শিবির সন্দেহে’ গত বছরের অক্টোবরে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট, ঢাবিসহ দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। বর্বরোচিত কায়দায় আবরারকে হত্যার প্রতিবাদ দেশের প্রায় সব শ্রেণি পেশার মানুষ জানান ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে।

ঢাবির প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী মঙ্গলবার রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘হল প্রশাসনের মাধ্যমে ঘটনাটি অবহিত হই। ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ওই চার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো তথ্যপ্রমাণ না পেলে তাদের কোনো ধরনের হয়রানি করা যাবে না, এটা আমরা বলে দিয়েছি।’

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় জানান, তিনি জানতে পেরেছেন যে শিবিরসংশ্লিষ্টতা থাকায় চার ছাত্রকে থানায় দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের মারধর করা হয়েছে কি না, তা তার জানা নেই। তিনি বলেন, কারো ওপর শারীরিক আঘাত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

অন্যদিকে মঙ্গলবার রাতে ঢাবির চার ছাত্রকে রাতভর নির্যাতনের প্রতিবাদে প্রক্টরের পদত্যাগসহ চার দফা দাবি এবং ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দুই বছরপূর্তি স্মরণে ১২টি ছাত্রসংগঠনের জোট ‘সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্যের’ ব্যানারে গত বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি ভিপি নুরুল হক অভিযোগ করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের অপকর্মের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে দাসপ্রথা কায়েম করেছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও অস্থিরতা চলছে। গত বুধবার দুপুরের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ছাত্রলীগের ‘বিজয়’ ও ‘সিএফসি’ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে বািবতণ্ডা হয়। পরে সিএফসি গ্রুপের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী হলে বিজয় গ্রুপের ওপর হামলা করলে তিনজন আহত হন। এরই জেরে দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী ও শাহ আমানত হলের সামনে অবস্থান নেন। দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টাধাওয়ার ঘটনার জেরে গত বৃহস্পতিবার থেকে ক্যাম্পাসে লাগাতার অবরোধের ঘোষণা দেয় ছাত্রলীগের একাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের প্রথম দিনে ক্যাম্পাসগামী শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে নগরের বটতলী থেকে একটি শাটল ট্রেন ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা থাকলেও তা যেতে পারেনি। দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনার জের ধরে গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত ও সোহরাওয়ার্দী হলে তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রলীগের ২০ নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ।

কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত মঙ্গলবার বেলা ১টার দিকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আনিসুর রহমান ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামসহ অন্তত ১৬ জন আহত হন। ছয় মাস ধরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে।

সংগঠন সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন দাবি, টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ দেওয়া ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দেখানোসহ নানা অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাদের পরিবর্তে প্রায় সাড়ে তিন মাস ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে আল নাহিয়ান খান জয় এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য দায়িত্ব পালন করেন। গত ৪ জানুয়ারি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তাদের দুজনকে ‘ভারমুক্ত’ করে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন নেতৃত্ব আসার পরও থামেনি ছাত্রলীগ।

তথ্যমতে, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়েই ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনটির সাংগঠনিক নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। দলের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদেরও ছাত্রলীগ নেতাদের সতর্ক করেছেন বহুবার। সংগঠনটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়েও বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন তিনি। গত প্রায় এগারো বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকারের আমলে ছাত্রলীগের অনেক ইতিবাচক কাজ ও অর্জন থাকলেও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সংগঠনটির এক শ্রেণির নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করলে হত্যা, খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির চিত্র ভেসে উঠে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্রলীগ এখন যা করছে, এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যের দুর্নীতি বের হচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা নৃশংসতা করছে। আমরা তো অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। এভাবে তো চলতে পারে না।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads