• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
দেখবেন একদিন আমরাও...

বিশ্বকাপ শুরুর অনেক আগে থেকে হইচই পড়ে যায় বাংলাদেশে

সংরক্ষিত ছবি

ফুটবল

সংবাদ ভাষ্য

দেখবেন একদিন আমরাও...

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৬ জুলাই ২০১৮

ভাঙল মিলনমেলা। গোটা দুনিয়া কাঁপিয়ে পর্দা নামল ফিফা বিশ্বকাপের। এমন কোনো দেশ বা জাতি নেই, যারা বিশ্বকাপ ফুটবলের জ্বরে আক্রান্ত হয়নি। আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, উচ্ছ্বাস-উৎফুল্লতা গোটা পৃথিবীকে স্পর্শ করে গতকাল রোববার চূড়ান্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত ঘটল এ মহাযজ্ঞের। গোটা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশও এ মহোৎসবে শরিক হয়েছিল। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ বেশি মাত্রায় উচ্ছ্বসিত-উদ্বেলিত হয়েছে। ফুটবলের প্রতি এ গভীর প্রেম থাকা সত্ত্বেও আমরা এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। তবে আজ আমাদের হিসাব-নিকাশ করার সময় এসে গেছে। আমরা কেবল পরদেশের সমর্থক হয়ে তাদের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনায় শরিক হয়ে আর কতদিন থাকব। এটা তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না।

বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সারা দেশে হইচই পড়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় বসেছিল বিভিন্ন দলের জার্সি-পতাকা ও স্যুভেনিরের দোকান। শহরের অলি-গলিতে শোনা যেত হকারদের হাঁকডাক। বিশ্বকাপ-সামগ্রী কেনার ধুম পড়ে গিয়েছিল আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে। দেশের রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের গৃহশীর্ষে শোভা পেত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের পতাকা। কারা জিতবে, কাদের সমর্থক বেশি- এ নিয়ে মাতামাতি হয়েছে, হাতাহতি হয়েছে, মারামারি হয়েছে, বাজি ধরা হয়েছে। প্রিয় দল জিতলে উল্লসিত আর হারলে বিমর্ষ হয়েছে ফুটবলভক্তরা। এমনকি সমর্থক দেশের পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ পতাকা তৈরি করা হয়েছে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে। এর নজির বিরল। এসবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বাঙালি ফুটবলপ্রিয় জাতি। এ জাতিকে ফুটবল থেকে দূরে রাখার কোনো উপায় নেই।

আমাদের এখনো মানসপটে ভেসে বেড়ায় সেইসব দিনের কথা, যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দলে একজন বঙ্গসন্তানও অন্তর্ভুক্ত হতো না। আমরা নাকি ক্রিকেট খেলতে পারি না। অথচ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের টাইগাররা বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন ক্রিকেট ভেন্যুতে পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করেছে। বাংলাদেশ আজ ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। বাঙালির হাতের কব্জির জোরে যদি বিশ্ব কাঁপানো যায়, এমনকি আমাদের নারীরাও যদি বিশ্বের বিভিন্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমরা বাঙালিরা পা ও মাথার খেলা অর্থাৎ ফুটবলে কেন পিছিয়ে থাকব?

যেকোনো ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে প্রয়োজন হয় দৃঢ়চেতা সংগঠকের। আমাদের চোখের সামনে সেই উজ্জ্বল ইতিহাস এখনো জ্বলজ্বল করছে। কীভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনার চুম্বক দিকনির্দেশনায় এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর চৌকস নেতৃত্বে বাংলাদেশের টাইগাররা ক্রিকেটের অত্যুজ্জ্বল মাইলফলক স্পর্শ করতে পেরেছিল। পরবর্তী সময়ে নাজমুল হাসান পাপনের নেতৃত্বে সেই অগ্রযাত্রা আজো অব্যাহত আছে।

হ্যাঁ, ফুটবলেও আমাদের রয়েছে সোনালি অতীত। আজো আমাদের তারকা ফুটবলারদের খেলার কথা ভাবলে মনে পড়ে তাদের নৈপুণ্যঘেরা খেলা। কাজী সালাউদ্দিন, সালাম মুর্শেদী, শেখ মুহাম্মদ আসলাম, শহীদুর রহমান সান্টু, কাওসার হামিদ, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন, দেওয়ান শফিউল আরেফীন টুটুল, বাদল রায়, নান্নু, মঞ্জু প্রমুখ তারকা খেলোয়াড় বিশ্ব ফুটবলে আলোড়ন সৃষ্টিকারী খেলোয়াড়দের চেয়ে কোনো অংশেই কম যাননি। তারাও তাদের আশ্চর্য ক্রীড়াশৈলী দিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে দর্শক টেনে এনেছিলেন। তারপরও কেন খরা নেমে এলো আমাদের ফুটবলে? আমরা কি পারি না সারা দেশ থেকে ২০ জন খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে? প্রতিটি জেলা থেকে একজন করে প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড় বাছাই করতে পারলে ৬৪ জন ফুটবলার কি খুঁজে বের করা যাবে না? এদের মাঝ থেকে জনাবিশেক তরুণ ও মেধাবী খেলোয়াড়কে নিয়ে যদি একটি টিম গঠন করে সার্বক্ষণিকভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে তোলা যায় এবং একটি স্থির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই বিশ্ব ফুটবলের ময়দানে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম হবে। অনেকে বলে থাকেন, ভালো ফুটবল টিম গঠন করার মতো অর্থ আমাদের নেই, অথবা আমাদের খেলোয়াড়রা শারীরিকভাবে ফিট নন, কিংবা আমরা ফুটবলের র্যাঙ্কিংয়ে অনেক পিছিয়ে। তাদের এসব যুক্তি অসার, অবাস্তব ও অযৌক্তিক। এবার বিশ্বকাপ ফুটবলে অনেক দেশ সেরা ৩২ দলে উঠে এসেছে, যারা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের পেছনের কাতারে, অনেক দেশ এসেছে যারা এক লাফে র্যাঙ্কিংয়ে অনেক সিরিয়াল পেছনে ফেলে মহাযজ্ঞে শামিল হয়েছে, অনেক দেশের প্লেয়ার রাশিয়ায় মাঠ কাঁপিয়েছেন, যাদের শারীরিক গতি-প্রকৃতি কিংবা গঠন আমাদের খেলোয়াড়দের চেয়ে উন্নত নয়। এবার বিশ্বকাপে যারা অংশ নিয়েছে তাদের মধ্যে স্বাগতিক রাশিয়া র্যাঙ্কিংয়ে পেছনে ফেলে এসেছে ৭০ ধাপ, সৌদি আরব ৬৭ ধাপ, জাপান ৬১ ধাপ, দক্ষিণ কোরিয়া ৫৭ ধাপ, পানামা ৫৫ ও নাইজেরিয়া ৪৮ ধাপ।

এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আমরা যদি নিখুঁতভাবে তৃণমূল থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড় বাছাই করতে পারি এবং ফুটবল ম্যানেজমেন্টে সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তাহলে নির্ভুল লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছানো সম্ভব। বিভিন্ন ফেডারেশন বা ক্লাবের কক্ষে বসে যারা অলস সময় কাটান, যারা নিজেদের বৈষয়িক প্রয়োজনে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিকে অতি বেশি মনোযোগী কিংবা বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, আধুনিক ফুটবলের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে নয়। উঠতি বয়সের উদীয়মান, মেধাবী এবং আধুনিক ফুটবলের চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ একদল তরুণের হাতে তুলে দিতে হবে ফুটবলকে উজ্জীবিত করার দায়িত্ব। বাছাই করা প্রস্তাবিত জাতীয় ফুটবল টিমের সদস্যদের মধ্যে একটি প্রেরণার জন্ম দিতে হবে— ‘ডু অর ডাই’। ‘হয় জিতব, না হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব’— এই মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে হবে সবাইকে। তাহলেই সম্ভব আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা রাখা।

বাঙালি জাতির সৌভাগ্য, আমাদের এমন একজন খেলাধুলাপ্রিয়, খেলোয়াড়বান্ধব প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি সব ক্ষেত্রে সাফল্যের মালা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম। জননেত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি নিজেই এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমি যা ধরি, ভালোভাবেই ধরি।’ তার এ কথার প্রমাণ মেলে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে অর্জিত সফলতায়। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার হাতে পরশ পাথর রয়েছে। তিনি যখন যা ছোঁবেন, তাই সোনা হয়ে ফলবে। এবার তাকে দৃষ্টি দিতে হবে ফুটবলের দিকে। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে দিয়ে বলতে হবে, ‘এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হবে।’ এখন বিশেষভাবে প্রয়োজন আমাদের খেলোয়াড়দের নতুন জামা-জুতা পরিয়ে নতুন এক ফুটবল জগতের দিকে এগিয়ে নেওয়া। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। তাই বলা যায়, বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে অচিরেই বাংলার দামাল ছেলেরা আর দশটি দেশের ফুটবলারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাঠ কাঁপাবে। সেদিন খুব দূরে নয়, দেখবেন একদিন আমরাও পারব। 

 

আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া 

সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads