ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! না হলে কেন তার এমন পরিস্থিতি। ছিলেন ফুটবলার। ২০০২ বিশ্বকাপে দ্রুততম গোলের বিশ্বরেকর্ড গড়ে লাইমলাইটে আসা। কিন্তু অবসরের পর নাম লেখালেন রাজনীতিতে। পতন সেখান থেকেই শুরু। প্রাণ বাঁচাতে বিশ্বকাপের তারকা খেলোয়াড় তুরস্কের হাকান সুকুর এখন উবার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন যুক্তরাষ্ট্রে।
দীর্ঘ ক্লাব ক্যারিয়ারে গ্যালাতাসারে, ইন্টার মিলান, ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে আড়াই শর বেশি গোল আছে সুকুরের। তুরস্কের হয়ে ১১২ ম্যাচে করেছেন ৫১ গোল। তবে তিনি বেশি আলোকিত ২০০২ বিশ্বকাপের জন্য। যেখানে সাউথ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর মাত্র ১০.৮ সেকেন্ডে গোল করেছিলেন। যা এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের দ্রুততম গোল।
২০১১ সালের আগ পর্যন্ত তুরস্কে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেতেন হাকান সুকুর। সেই গর্বেই কি না দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল একেপি পার্টিতে যোগ দেন ‘বুল অব বসফরাস’ নামে খ্যাত এ ফুটবলার। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎই ২০১৩ সালে সেই সম্পর্কে ধরে ফাটল। ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে তার একসময়ের সবচেয়ে কাছের মানুষ ফেতুল্লা গুলেনের। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হন ফেতুল্লা। সেটির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এরদোয়ানের চক্ষুশূলে পরিণত হন হাকান সুকুর, ২০১৩ সালে পদত্যাগ করেন একেপি পার্টি থেকে।
তিন বছর বাদে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনেন সুকুর। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে টুইট তাকে পরিণত করে সরকারের শত্রুতে। এরপর জনগণের যতটুকু সমর্থন ছিল সেটাও হারান নিজেকে ‘আলবেনিয়ান’ দাবি করে। ২০১৬ সালে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে তুরস্ক সরকার। হাকান সুকুর পরিণত হন রাষ্ট্রের শত্রুতে। তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, বাস্তুচ্যুত করা হয় দেশ থেকে। গ্রেপ্তার হন এ ফুটবলারের বৃদ্ধ বাবা। প্রাণভয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আসেন সুকুর।
কেমন আছেন ৪৮ বছর বয়সী এ ফুটবলার? ওয়াল্ট এএম সোনাটাগকে সুকুর বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বেঁচে থাকার জন্য আমি এখন উবার চালাই।’ টুইটারে সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ায় ক্ষণে ক্ষণে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন সুকুর। মূলত সে কারণেই পালিয়ে আসা যুক্তরাষ্ট্রে। বাস করেন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে, ‘ওরা আমার স্ত্রীর গায়ে পাথর ছুড়েছে, বাচ্চাদের রাস্তায় অপমান করেছে। যতবারই বিবৃতি দিয়েছি, ততবারই হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। যখন দেশ ছেড়ে এসেছি, আমার বাবাকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমার যত সম্পত্তি ছিল সব বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। দুনিয়ায় আর কিছুই বাকি নেই আমার। এরদোয়ান সব কেড়ে নিয়েছে। আমার স্বাধীনতা, নিজেকে ব্যাখ্যা করার, প্রকাশের অধিকার, কাজ করার অধিকার, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।’
জেল থেকে ছাড়া পেলেও এখন গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে সুকুরের বৃদ্ধ বাবাকে, তিনি ক্যানসারে ভুগছেন। তার মা-ও আক্রান্ত নানা রোগে, ‘খুব কঠিন সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। কেউ যদি আমাকে সাহায্য করতে যায় তাহলে তাকে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত করে রাখা হয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় একটা ক্যাফে দিয়েছিলাম। আচমকা কোথা যেন সব অচেনা লোক এসে ডোম্বরা সংগীত (একেপি সরকারের মতে এই সংগীত তুরস্কের মানুষের প্রাণের সংগীত) বাজানো শুরু করল!’
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এক প্রবাসী তুর্কি ছাত্র তার সঙ্গে সেলফি তোলায় সেই ছাত্রকে ১৪ মাসের জেল খাটতে হয়েছে বলে শুনেছেন সুকুর, ‘যখন আমি একেপি পার্টিতে যোগ দিই, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে দেশকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) মতো করে চালানো হবে এবং ইউরোপ থেকে প্রচুর বিনিয়োগ আনা হবে। কিন্তু এরদোয়ান সরকার উল্টাপথে চলা শুরু করল। ইউরোপীয় না হয়ে বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশে পরিণত হয়েছে তুরস্ক। বিশ্বের অনেক দেশের মতো তুরস্কেও ফুটবল স্বাধীন কিংবা স্বায়ত্তশাসিত নয়। অথচ তুর্কি গণমাধ্যম আমাদের ক্রমাগত আক্রমণ করে গেছে, আমরা যেন মুখ না খুলি। তারা সব সময় চেয়েছে, অন্য অ্যাথলেটরা ভয়ে থাকে। তারা বলতে পারবে আমি কোন অপরাধটা করেছি? পারবে না। তারা শুধু বলছে আমি বিশ্বাসঘাতক আর সন্ত্রাসী। আমি হয়তো সরকারবিরোধী, কিন্তু তুর্কি জনগণের নই। আমি আমার দেশ ও পতাকাকে ভালোবাসি।’