• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ফুটবল

তুমি ছিলে তুমি রবে

  • মাহমুদুন্নবী চঞ্চল
  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর ২০২০

‘নক্ষত্রেরা চুরি করে নিয়ে গেছে/ ফিরিয়ে দেবে না তাকে আর।’ জীবনানন্দের কবিতার মতোই যেন নক্ষত্রলোকে চলে গেলেন তিনি। আর কখনো ফিরবেন না। তবে তিনি এই মর্ত্যে থাকবেনও আবার। আক্ষরিক অর্থে দেহত্যাগ হলেও তার কীর্তি যে এখনো দেদীপ্যমান। তিনি কিংবদন্তি, আর কিংবদন্তিরা কখনো মরেন না। শত সহস্র বছর বেঁচে থাকেন কোটি মানুষের হূদয়ে। তেমনি ম্যারাডোনা যেমন ছিলেন, তেমনি রবেন ভক্তকুলের অজস্র ভালোবাসায়।

দিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। ফুটবলেরই সমার্থক এক নাম। হতদরিদ্র এক পরিবার থেকে আকাশছোঁয়ার বাসনায় বেছে নিয়েছিলেন ফুটবল নামের অদ্ভুত জিনিসটাকে। আর সেই চর্মগোলক দিয়েই জয় করেছেন গোটা বিশ্ব। জায়গা করে নিয়েছিলেন কোটি ভক্তের হূদয়ে। কিন্তু অমোঘ নিয়মে মাত্র ৬০ বছর বয়সেই সেই ম্যারাডোনা পাড়ি জমিয়েছেন অন্যলোকে। গোটা বিশ্ব আজ বাকরুদ্ধ, শোকস্তব্ধ।  

কারো কাছে তিনি ফুটবলের রাজপুত্র। কারো কাছে স্বয়ং ফুটবল ঈশ্বর। বুয়েনস আইরেসের তস্য গলি থেকে সাফল্যের রাজপথে বিচরণ করেছিলেন শুধু বাঁ পায়ের জাদুতে। সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেছিলেন বিদ্যুৎ গতিতে। রাতারাতি হয়েছিলেন তরুণ প্রজন্মের ‘আইকন’। খ্যাতি আর বিতর্ক তার জীবনে হাত ধরাধরি করে চলত। সীমাহীন ভালোবাসায় পূর্ণ ও বাঁধনহারা জীবন ছিল তার। কত বর্ণিল ক্যারিয়ার ফুটবলের এই জাদুকরের।

১৯৭৮ বিশ্বকাপে উপেক্ষিত, ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে লাল কার্ডের হতাশা। দিয়াগো ম্যারাডোনা নিজের মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপই ম্যারাডোনাকে এনে দেয় আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। বিশ্বের নানা প্রান্তে তরতর করে বাড়তে থাকে তার ভক্ত। ভাঙাচোরা দল নিয়ে একক প্রচেষ্টায় আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতান তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচটি হয়ে থাকে ঐতিহাসিক। একই সঙ্গে তিনি নন্দিত ও নিন্দিতও। এই ম্যাচেই এরিয়েল বক্সে বিতর্কিত হাত দিয়ে গোল, যা এখন হ্যান্ড অব গড নামে পরিচিত। এই ম্যাচেই আবার মাঝ মাঠ থেকে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে কয়েকজনকে কাটিয়ে ম্যারাডোনা করেছিলেন এক গোল, যে গোল পরে পেয়েছিল সেঞ্চুরি অব দ্য গোলের তকমা।

হ্যান্ড অব গডের কারণে ইংল্যান্ডবাসী আজো হয়তো ক্ষমা করতে পারেনি ফুটবলের রাজপুত্রকে। আর তাই ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর প্রশংসার পাশাপাশি টিপ্পনী কাটতে ছাড়েননি সাবেক ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার। টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘ম্যারাডোনা এখন ঈশ্বরের হাতে শান্তি খুজবেন।’ তাতে অবশ্য ম্যারাডোনার মাহাত্ম্য কমে যাবে না। গোটা বিশ্বে ম্যারাডোনার জন্য শোকের মিছিল তার প্রবল জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে।

১৯৯০ বিশ্বকাপটা জিততে পারতেন ম্যারাডোনা। ভাগ্য সহায় হয়নি। ফাইনালে রেফারির বিতর্কিত গোলে হেরে যাওয়ায় ম্যারাডোনার কান্না কাঁদিয়েছিল সবাইকে। এরপর থেকেই ক্রমশ ম্যারাডোনা যেন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হতে শুরু করেন। নাপোলিতে ইতিহাস রচনার পর ১৯৯১ সালে কোকেন নেওয়ার অপরাধে হন ১৫ মাস নিষিদ্ধ। শেষ হয় নেপলস অধ্যায়। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ মহাকেলেঙ্কারিতে পূর্ণ। ড্রাগ নেওয়ার অপরাধে ম্যারাডোনা হন নিষিদ্ধ। ম্যারাডোনাও আস্তে আস্তে প্রবেশ করেন নেশার কালো জগতে। কিন্তু তারপরও পেছনের কালো অধ্যায় মুছতে সক্ষম হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। হয়েছিলেন আর্জেন্টিনার কোচ, ২০১০ বিশ্বকাপে দলকে উঠিয়েছিলেন কোয়ার্টার ফাইনালে। এরপর বিভিন্ন ক্লাবে কাজ করা ম্যারাডোনা হঠাৎ করেই উড়াল দিলেন অজানার উদ্দেশে।

বেপরোয়া, প্রতিভাবান, আগ্রাসী এবং একজন অনুগত বন্ধু। ম্যারাডোনা সর্বদাই ছিলেন ফুটবলভক্তদের জন্য তীব্র আকর্ষণীয় চরিত্র। তার জনপ্রিয়তার একটা উদাহরণ পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিকের লেখায়, ‘১৮ বছর বয়সে ম্যারাডোনা আফ্রিকায় নেমে ঠিকমতো হাঁটতে পারেননি। তাকে একবার দেখার জন্য জনপ্লাবন আছড়ে পড়েছিল রানওয়েতে। বিমান আটকে গিয়েছিল। এই বিপুল জনপ্রিয়তাই বার বার বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল দিয়াগোকে। খেলার পর মাদকে ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। কপিবুক মানতেন না মাঠে, জীবনেও। সেখান থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার লড়াই চলেছে। কখনো ফিরে আসতে পারবেন ভাবিনি। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিল দিয়াগো। ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া যা সম্ভব ছিল না।’

অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী ম্যারাডোনা ছিলেন পাগলাটেও। ভক্তরা সব তার ভুল মেনে নিত পরম ভালোবাসায়। কত কাণ্ডই তিনি করেছেন ক্যারিয়ারে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ার পর দিগ্ভ্রান্ত ছিলেন ম্যারাডোনা। বাড়ির সামনে প্রায়ই জড়ো হতেন সাংবাদিকরা। এক সাংবাদিককে লক্ষ্য করে গুলিই চালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। যার জন্য দুই বছর ১০ মাস কারাদাণ্ডে দণ্ডিত হন দিয়াগো। স্টেজ বেয়ে বেপরোয়া ভক্তরা আসতে শুরু করলে বাঁ পা ব্যবহারের নিদর্শনও রেখেছেন ম্যারাডোনা। ভক্তরা আপন মনে সব ক্ষমা করে দিয়েছেন প্রিয় ফুটবলারের জন্য।

একটা মানুষের জন্য কত আবেগ, কত ভালোবাসা থাকলে এমনটি হয়। বেঁচে থাকতে যার সঙ্গে খুনসুটি হতো সারাক্ষণ ম্যারাডোনার, সেই পেলেও বলেছেন, ‘একসঙ্গে আমরা স্বর্গে ফুটবল খেলব।’ বন্ধু বনে যাওয়া রোনালদো বলেছেন, একজন বন্ধুকে চিরবিদায় জানাতে হচ্ছে। স্বদেশি ও গুরু ম্যারাডোনাকে হারিয়ে লিওনেল মেসি ভীষণ আপ্লুত, তিনি চিরন্তন, বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।’

ম্যারাডোনা নেই। আজ তিনি কেবলই ছবি। শুধুই স্মৃতির অ্যালবাম। যে অ্যালবামের পাতায় পাতায় ঠাসা জাদুকরী সব কীর্তি। অত্যাশ্চর্য সব বীরত্বগাথা। সেসব সোনালি কীর্তিতেই তিনি বেঁচে থাকবেন যুগের পর যুগ। মাঠের বাইরে নানা পাগলামি আর ছেলেমানুষি কাণ্ডকারখানা আলোচনার খোরাক জোগালেও তিনি থাকবেন নিতান্তই আপনজন হিসেবে। ম্যারাডোনার স্মৃতিতে তাই সন্ধ্যার আঁধার নামবে না কখনো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads