• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

ভ্রমণ

মহেশখালী ও সোনাদিয়া দ্বীপ ভ্রমণ

  • তাবাসসুম তৈয়্যবা
  • প্রকাশিত ৩১ আগস্ট ২০১৯

ভার্সিটি বন্ধ থাকায় ছুটিতে নতুন কোথায় যাওয়া যায় তা নিয়ে বন্ধুদের মাঝে আলোচনা করে ঠিক করা হলো ঈদের পরদিন সোনাদিয়া দ্বীপ ভ্রমণে যাব। প্ল্যান মোতাবেক সাতজন একসঙ্গে সাইকেলে চেপে প্রথম দিন মহেশখালী পৌঁছালাম। মহেশখালীতে তৃতীয়বারের মতো যাওয়া। স্থানীয় গ্রিন প্যালেস হোটেলে রাতটা কাটিয়ে সকালে আদিনাথ জেটিঘাট ও আদিনাথ মন্দির বেড়িয়ে সোজা চলে গেলাম ঘটিভাংগা ঘাটে। খালে জোয়ার শুরু হলেই ঘটিভাংগা ঘাট থেকে সোনাদিয়া দ্বীপের উদ্দেশে নৌকা ছাড়ে। ৪০ মিনিটের এই নৌকাভ্রমণ হতে পারে যেকোনো কারো কাছে দারুণ এক অভিজ্ঞতা। খালের দুপাশে সবুজে ভরা প্যারাবন ও হরেক রকম কাঠের নৌকা দেখে মনে হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌকা চলছে।

সোনাদিয়া ৯ বর্গকিমি এলাকার এক অনন্য সুন্দর দ্বীপ যা সাগরকেন্দ্রিক বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের আঁধার। মহেশখালী থেকে এই দ্বীপ একটি খাল দ্বারা বিভক্ত। দ্বীপটিতে দুটি পাড়া- পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়া। নৌকা থেকে নেমে আমরা পশ্চিমপাড়ায় যাই যেখানে স্থানীয় জসিম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগে থেকেই আমরা থাকা-খাওয়ার বিষয়ে ঠিক করে নিই। উল্লেখ্য, সোনাদিয়া দ্বীপে থাকা বা খাওয়ার কোনো হোটেলের ব্যবস্থা নেই। এখানে থাকতে ও খেতে হলে একমাত্র স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আগে থেকে বন্দোবস্ত করেই থাকা যায়। স্থানীয় জসিম ভাইয়ের কন্টাক্ট নাম্বার আমরা টিওবি থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম। খুবই অমায়িক ও অতিথিপরায়ণ জসিম ভাই আমাদের জন্য সুন্দর ও অল্প খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দ্বীপে পা দেওয়ার পরপরই সাইকেল চালিয়ে ও হেঁটে সোজা চলে যাই সমুদ্রপাড়ে।

সোনাদিয়া ভ্রমণের আগে আমার দেখা দেশের সেরা সমুদ্রসৈকত ছিল কুতুবদিয়া সৈকত, কিন্তু জনমানবশূন্য ও আবর্জনাবিহীন সোনাদিয়া সমুদ্রসৈকত দেখে কুতুবদিয়াকে টপকে সোনাদিয়াকেই ওপরে রাখতে বাধ্য হলাম। নির্জন সৈকতের ঢেউয়ের শব্দ আর ঝাউবনের শন শন শব্দের এক অদ্ভুত মাদকতায় কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকাল নেমে এলো কেউ টেরই পাইনি। জসিম ভাইয়ের ছিমছাম শান্ত বাড়িতে গিয়ে টিউবওয়েলের ঠান্ডা পানিতে গোসল করে ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে ডাল, আলু ভর্তা আর মুরগির মাংস দেখে পেটের চরম ক্ষুধার কথা সবার মনে পড়ে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে কয়েক বাড়ি পাশেই ছোট এক দোকানে চা খেয়েই ছুটলাম খালের পাড়ের দিগন্ত বিস্তৃত সবুজঘেরা মাঠের উদ্দেশে। পড়ন্ত বিকালে ঘাসের চাদরে বসে শুরু হলো ডাবের সুমিষ্ট পানি পান।

কপাল ভালো থাকলে যা হয় আর কি, বোনাস হিসেবে পেলাম পূর্ণ চাঁদের আলো। সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সৈকতে বসে নিজেদের চাঁদের শুভ্র আলোতে স্নান করানোর সুযোগ কি আর মিস করা যায়। বর্ষার সময় বলেই তাঁবুবাস ও বারবিকিউয়ের ইচ্ছা মাথা থেকে বাদ দিয়েছিলাম, নয়তো তাঁবুবাসেরও ভালো ব্যবস্থা আছে। জসিম ভাই সে ব্যবস্থাও করে দিতে পারেন। শহরের ব্যস্ততা ও কোলাহল থেকে দূরে, বৈদ্যুতিক আলো, বাতাসের কৃত্রিমতা ফেলে প্রকৃতির খুব কাছ থেকে নিজেকে ও জীবনকে উপভোগ করার দারুণ এক জায়গা সোনাদিয়া দ্বীপ। শীতের সময় আরো একবার যাওয়ার ইচ্ছা মনে পুষে রেখে পরদিন খুব ভোরে সূর্যোদয় দেখে ও গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে আবার নৌকায় চেপে বসলাম মহেশখালীর উদ্দেশে।

ভ্রমণসহায়ক তথ্য

সোনাদিয়া দ্বীপে ইলেকট্রিসিটি নেই তাই মোবাইল চার্জের জন্য পাওয়ার ব্যাংক নেওয়া আবশ্যক। নেটওয়ার্ক থ্রি-জি পর্যন্ত পাওয়া যায়। মহেশখালী ঘটিভাংগা ঘাট থেকে প্রতিদিন সকালে জোয়ারের সময় (সকাল ১০টা ও বেলা ১১টার দিকে) সোনাদিয়ার উদ্দেশে বোট ছাড়ে, ভাড়া ৩০ টাকা জনপ্রতি। আমাদের মতো সাইকেলসহ পার হলে অবশ্য কিছুু বাড়তি দিতে হবে, আমরা সাইকেলপ্রতি ৩০ টাকা করে দিয়েছিলাম। সোনাদিয়ায় থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা একমাত্র স্থানীয়দের বাড়িতেই সম্ভব। তাই যাওয়ার আগে অবশ্যই যোগাযোগ করে সব বন্দোবস্ত করে যাবেন। টিওবিতে সোনাদিয়া দ্বীপ সার্চ করলেই কয়েকজনের কন্টাক্ট নাম্বার পেয়ে যাবেন। আমরা যোগাযোগ করেছিলাম জসিম ভাইয়ের সঙ্গে, খুবই ভদ্র, সাহায্যকারী ও সোজা কথার মানুষ। যেখানেই থাকেন না কেন পুরোটাই  গ্রাম, তাই এমন কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকবেন যা দেখে স্থানীয় মানুষ বিরক্ত হয়। সবাই খুব আন্তরিক ও সহজ-সরল।

আমরা চট্টগ্রাম থেকে সাইকেলে গিয়েছিলাম। যারা গাড়িতে যেতে ইচ্ছুক তারা চট্টগ্রাম নতুন কর্ণফুলী সেতুর মোড় থেকে সানলাইন নামক গাড়িতে সরাসরি বদরখালী জনতা বাজার পর্যন্ত যেতে পারবেন, ভাড়া পড়বে ২২০ টাকা। জনতা বাজার থেকে সরাসরি সিএনজিতে চলে যেতে পারেন আদিনাথ সড়ক বা গোরকঘাটা বাজারে (ভাড়া ১০০)। যেখানে স্থানীয় হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা দিতে পারেন ৬-৭ কিমি দূরের ঘটিভাংগা ঘাটের উদ্দেশে। আমরা আদিনাথ সড়কের হোটেল গ্রিন প্যালেসে উঠেছিলাম। দুটি ডাবল বেড (চারজন) নিয়ে এক রুমের ভাড়া পড়েছিল ৫০০ টাকা, এক রাতের জন্য। সোনাদিয়ায় জসিম ভাইয়ের বাড়িতে এক রাত থাকা ও তিন বেলা খাবারের জন্য দিতে হয়েছিল জনপ্রতি ৬০০ টাকা। দুপুর ও রাতের মেন্যু ছিল ভাত, আলু ভর্তা ও মুরগি আর সকালে গরম গরম খিচুড়ির সঙ্গে ডিম ভাজা।

সোনাদিয়া দ্বীপে ভ্রমণপিয়াসীদের ভিড় নেই বললেই চলে যে কারণে মনুষ্যসৃষ্ট ময়লা-আবর্জনাও নেই। দ্বীপে ভ্রমণকালে যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে অন্যান্য সমুদ্রসৈকতগুলোর মতো এই সমুদ্রসৈকতটিকেও নোংরা করা থেকে সবাই বিরত থাকব। এই দ্বীপে সমুদ্রের পানিতে গোসল করতে নামলে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত কারণ কোনো অঘটন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই সাহায্য পৌঁছানো অসম্ভব কারণ সৈকতে জনমানুষের আনাগোনা খুবই কম।

যদিও এই দ্বীপে অবস্থানকালে কোনো ট্রাভেলার এখনো পর্যন্ত অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হননি। তবে একটু দূরে বা নির্জন স্থানের দিকে কৌতূহলবশত যদি যেতেই হয় তবে অবশ্যই স্থানীয় কোনো ব্যক্তির পরামর্শ নিয়ে গেলেই ভালো। এই দ্বীপে একটি কচ্ছপ প্রজননকেন্দ্র রয়েছে। তাই সৈকতে অবস্থানকালে একটু সাবধানতা অবলম্বন করবেন যেন কোনোভাবেই আপনার গতিবিধি কচ্ছপের চলাফেরায় হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads