• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ভ্রমণ

ভুটান ভ্রমণের আদ্যোপান্ত

  • প্রকাশিত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সাহাবুদ্দীন শরীফ

 

 

ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। ভালোলাগার অন্যতম কারণ, ঘুরতে গেলে পড়া লাগে না, স্কুলে ফাঁকি দেওয়া যায়। যখন বাসা থেকে একা এদিক-সেদিক যাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেওয়া বন্ধ করে দিল, এরপর থেকেই দেশের এদিক-সেদিক ঘুরেছি, ঘুরছি। ফটোগ্রাফি করার সুবাদে দেশীয় সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিদেশি অনেক সুন্দরের প্রতি আমার দুর্বলতা আজীবনের, স্বপ্ন দেখি সেসব পদার্পণের, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ভুটান। এই দেশটি আমার কাছে অধরা মনে হতো, মনে হতো আরাধ্য। অনেককে যেতে দেখতাম, কিন্তু নিজে যাব সেটি ভাবতে পারতাম না কেন জানি। পরে কাছের অনেককে যেতে দেখে মনে আপনা-আপনি সাহস জমতে শুরু করল। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো-রাহুল, কলেজজীবন থেকে আমরা বন্ধু।

থিম্পু

যথারীতি আগের বুকড করা রিসোর্টে পৌঁছেই তো আমরা থ, এটি কোনো রিসোর্ট নয়, পাহাড়ের ওপর কোনো শিল্পীর নিজের জীবনের সব শিল্পসত্তা ঢেলে দিয়ে বানানো একটি স্বপ্ন মহল। কাঠ আর কংক্রিটের মিশেলে নির্মিত ডুপ্লেক্স একটি বাংলো। সুন্দরী গাকি এবং তার পরিবারের এই শিল্পে তারা থাকার পাশাপাশি পেয়িং গেস্ট হিসেবে আমাদের রাত্রিযাপনের জায়গা হয়েছে এখানে। এই বাংলোর সামনের দিকের প্রতিটি প্যানারোমা জানালা দিয়ে উপভোগ করা যায় অনেক নিচের থিম্পু শহরের রাতের রূপ। তবুও এত দূর থেকে থিম্পু দেখে মন না ভরাতে সিদ্ধান্ত হলো, ডিনারের পরে আমরা শহরে যাব। ভুটানের রাস্তাগুলো বড় বড় পাহাড়গুলোতে ৩৬০ ডিগ্রিতে কেটে কেটে বানানো, যার কারণে গাড়িগুলোর একটি পাহাড় পার হতেই লেগে যায় অনেক সময়। আমাদের রাতে বের হওয়ার উদ্দেশ্য হলো, রাতের থিম্পু দেখা আর নাইটক্লাবে উঁকি দেওয়া, শহরে গিয়ে জানতে পারলাম সেদিন ক্লাব সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। কক্সবাজারের প্ল্যান করে শেষে যেতে না পেরে পতেঙ্গা সমুদ্র ভ্রমণ টাইপ একটি ক্লাবে গেলাম আমরা। ভ্রমণসঙ্গী ইমামের মতে, সে রাতে আমরা কিছু স্কুল বাচ্চাদের নাচ দেখে অতঃপর বাংলোতে ফিরলাম, ফিরেই জমে উঠল গানের আসর। গান শেষে ঘুমাতে গেলাম। সকালে বের হলাম সাইড সিয়িংয়ে। প্রথমেই গেলাম থিম্পুর বিখ্যাত লোকাল মার্কেট এরিয়ার, এখানে মিলে ভুটানের বিখ্যাত যতসব হস্তশিল্প এবং বিখ্যাত সব স্থানের প্রতিকৃতি। পর্যটকদের ভুটান-সম্পর্কিত কেনাকাটার প্রধান মার্কেট এটি। কেনাকাটা শেষ হতেই একটু দূরের একটি মনস্ট্রিতে গেলাম আমরা, এই মনস্ট্রির পাশের এক চাচার দোকানের শিঙাড়া বেশি মুগ্ধ করেছিল আমায়, মাত্র ১০ রুপিতে এত বড় আর মজাদার শিঙাড়ার খোঁজ দেওয়ার জন্য অন্তর থেকে ধন্যবাদ সানী ভাই, মাজেদ ভাই আর নাসের ভাইকে। শিঙাড়া আর মনস্ট্রি পর্ব শেষ করে আমরা যাত্রা অব্যাহত রাখলাম থিম্পুর আরো বিখ্যাত বুদ্ধা টেম্পলের দিকে। ভুটানের বিখ্যাত সবকিছুই মোটামুটি পাহাড়ের ওপর তেমনি এই বুদ্ধা টেম্পলও এর ব্যতিক্রম নয়, এই টেম্পল এরিয়া এবং এর আশপাশে সদ্য বৃষ্টিস্নাত নিম্ন এরিয়াগুলো দেখতে অপূর্ব লাগছিল, মেঘগুলো ‘যেন’ আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছিল নয়, মেঘগুলো এলেই আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল একটু পরপর। টেম্পলের নিচেই এই ট্যুরের প্রথমবারের মতো হিমালয়কন্যা দেশগুলোর বিখ্যাত খাওয়ার মম চেখে দেখেন অনেকে এবং এর পরপরই আমরা যারা খাইনি তাদের ভাগ্যবান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। টেম্পলে মেঘবিলাস আর মম পর্ব ফুরিয়ে গেলে আমরা রওনা দিলাম, যাত্রা অনেক দূরের ফোবজিকা ভ্যালী, এই ট্যুরের সবচে আকর্ষণীয় স্থান। পথে পুনাখা শহরে থামলাম লাঞ্চের জন্য। পরদিন ফোবজিকা থেকে ফিরে পুনাখাতে আমাদের এক দিন থাকা হবে। ফোবজিকাতে আমরা থাকব এক স্থানীয় কৃষক পরিবারের ফার্ম হাউজে, তাদের হাতেই রান্না হবে রাতের খাবার। পরদিন সকালে খাওয়ার জন্য কিছু শুকনো খাবার কিনে রওনা দিলাম ফোবজিকার দিকে।

ফোবজিকা

যথারীতি গিয়ে পৌঁছালাম রাতে, আশপাশ দেখার সুযোগ হলো না সেদিনও, তাদের ফার্ম হাউজটি দোতলা, নিচতলা এখনো থাকার উপযোগী হয়নি, সুতরাং আমাদের থাকার জায়গা হলো দোতলায়, ঘরের ভেতরের কন্ডিশন অনেকটা আমাদের মতোই, কাঠের সিঁড়ি বিয়ে দোতলায় উঠতেই প্রথমে একটি খোলা বারান্দা এবং সেটি পার হতেই একটি ড্রয়িংরুম এবং সেটিকে ঘিরে ৪-৫টা শোবার ঘর। এত রিমোট একটি এরিয়াতে এমন সুন্দর ঘর আর এর বিছানাগুলো আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। বলে রাখি রিমোট এরিয়া বলেই এসব স্থানে লোকাল গাড়ি খুব একটি মেলে না, কিন্তু প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারেরই নিজেদের ছোট ছোট কার আছে এবং মহিলারাও পটু ড্রাইভিংয়ে। আছে এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক আর ৮০ শতাংশ এলাকায় ফোরজি সেবা।

ভুটানের অন্যসব জায়গাতে আমরা অল্প জানা ইংরেজি আর হিন্দি মিলিয়ে কথোপকথনে পার পেয়ে গেলেও ধরাটা খেলাম এখানে এসে। এই ঘরের মালিক-মালকিনরা না জানে ইংরেজি, না হিন্দি। আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার আরুন তার দক্ষ হাতে গাড়ি সামলানোর মতো করে এখানেও আমাদের সামলে নিল, দোভাষীর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। ঘন ডাল, সাদা ভাত, কম ঝালের কিন্তু অনেক বড় এক ধরনের মরিচ ভাজা এবং মিক্সড একটি সবজি দিয়ে সারলাম স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ একটি রাতের খাবার, অসাধারণ তাদের রন্ধনশৈলী। এদের খাওয়া একটু বেশি দামের কারণে আগে থেকেই প্ল্যান ছিল পরদিন দুপুরে এখানে না খাওয়ার। অতঃপর রাতে খাওয়ার পর মাজেদ ভাই জানিয়ে দিলেন যত দামই হোক, পরদিন সকালে ফোবজিকা সাইড সিয়িং করে দুপুরে এখানেই খাব। সর্বশেষ মাঝ রাতে সবার অংশগ্রহণে শুরু হলো সংগীত পর্ব, ৩য় দিনের এপিসোড ৩-এর আসর। সবচে বেশি মজা করে গান গেয়েছিলাম আমরা সেদিন। আর সব শেষেরও শেষে ঘুমাতে গেলাম, সকালে উঠে চক্ষু চড়কগাছ, না কিছু খোয়া যায়নি, শুধু দৃষ্টি ছাড়া।

আগের প্রতিটি থাকার জায়গা পাহাড়ের ওপরে হলেও এই বাংলো অনেকটা সমতলে, পাহাড় বেয়ে নেমে আসা একটি ভ্যালির মাঝখানে আর তার চারদিকে আলুর ক্ষেত। সবুজের সমারোহের মাঝখানে একটি বাড়ি, উফ সে যে কি ছোট জুড়ানি। বিছানা থেকে চোখ মেলতেই গিয়ে আটকাচ্ছে দূরের ক্ষেত, তার পরের ভ্যালি অথবা তারও পরের পাহাড়ে। ঘরের ভেতর বেশিক্ষণ নিজেদের আটকে রাখা গেল না, সারি সারি পাইন গাছে ভরা পাহাড়ের মাঝের পথ পাড়ি দিয়ে আমরা উপত্যকা/ভ্যালির রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম, আরো অনেক দূর এই উপত্যকার মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলাম আমরা। এত দূরের পাহাড়েও ঘন ঘন পাইন গাছের বাগান এবং তাদের বেড়ে ওঠার প্রয়াস দেখে অনুভব করলাম কেন ভুটান একটি কার্বন নেগেটিভ দেশ। কাশ্মীর কিংবা সুইজারল্যান্ড না যাওয়া আমি ফোবজিকা ভ্যালিকে তাদের সঙ্গে তুলনায় দাঁড় করালাম, ভ্যালিতে দেখা ঘোড়াগুলোও আমার তুলনার মাত্রা বাড়িয়ে দিল যেন। বিস্তীর্ণ সবুজ ভ্যালিতে আমরা দুপুর পর্যন্ত দুরন্তপনায় মেতে উঠেছিলাম। এমন সৌন্দর্যতে বিমোহিত হয়ে আমরা যেন ফিরতেই চাইছিলাম না, ফিরতামও না, যদি আরুন গাড়ি নিয়ে আমাদের নিয়ে না আসত, আর এটা লেখার জন্যও ফিরে আসাটা দরকার ছিল, না হয় আপনারা জানতেন কি করে? ফার্ম হাউজে ফিরে আবার সেই অমৃত দিয়ে লাঞ্চ সারলাম, শেষে বড় পাতিল থেকে ঢেলে এক মগ চা, তাদের বিদায় দিয়ে ফিরে চললাম। পথে ফোবজিকার খুব কাছে একটি মনস্ট্রি দেখতে গেলাম, অধিকাংশই কাঠের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই মনস্ট্রির বয়স কম করে হলেও হাজার খানেক হবে, হাজার বছর আগেও এখানকার মানুষ কতখানি শৈল্পিক ছিল, এর নির্মাণশৈলী দেখে ধারণা করা যায়। কিছু সময় পর এবার ফেরার পালা, উদ্দেশ্য এবার পুনাখা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads