• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
ক্রিসতং অভিযান

সংগৃহীত ছবি

ভ্রমণ

ক্রিসতং অভিযান

  • এ আই শাহ রাজন
  • প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০২১

সারাদিনের বাসে যাত্রা শেষে নৌকাযোগে উঠলাম আলীকদম থেকে দুসরিবাজার। বাজার করতে হয়েছে আলীকদমেই। পাড়াতে নিজেদের রান্না করেই খেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। আমরা হাঁটছি তো হাঁটছিই-ফোনের মৃদু ফ্লাশের আলোয়। হঠাৎ সবাই দুপাশে ঝিরি, মাঝের পাথুরে শুকনো মাটিতে বসে পড়লাম। ফ্লাশ বন্ধ করতেই এক আকাশের লক্ষাধিক তারা দেখি ঝাঁপি মেলে ধরছে ছাতার মতন। ছোট্ট ঈদের চাঁদ ঐ দূরে আমাদের নিমন্ত্রণ জানাল নেটওয়ার্কবিহীন গাঢ় সবুজের পাহাড়ে।

এর আগে খণ্ড খণ্ড সুযোগে দেখা হয়েছিল চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা ও বম জনগোষ্ঠীর জীবন। এবার দেখব মুরং জনগোষ্ঠীর।

হিম শীতল বাতাসে পাহাড়, ঝিরি পেছনে ফেলে একটা সময় নিজেদের নিয়ে উঠলাম অচেনা এক মুরং পরিবারের ঘরে। হাড় কাঁপানো হিম পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে চললাম রাতের খাবারের জোগাড়যন্ত্রে। বাঁশের চাটাইয়ে গড়া ঘরে ভাঙা অংশ গলে হু-হু করে ঢুকছিল পাহাড়ি ঠান্ডা। আড্ডা শেষে এক লাইনে পাশাপাশি শুয়ে কম্বল, শতরঞ্জি আর মুরং জনগোষ্ঠীর নিজেদের বুননে শীতলপাটিতে আগলে ধরলাম নিজেদের।

সকালে উঠতেই মন ভরে গেল নিজেদের দেখে। ফুটফুটে আলোয় নিজেদের আবিষ্কার করলাম ‘মেনকিউ পাড়ায়’। পাহাড়ের ভাঁজে ছিমছাম গোছানো এ পাড়ার পাশে দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অবিরত অকৃত্রিম ঝিরি মৃদু তালে। ঘোর লেগে যায় ঝিরির এ শব্দে। প্রাকৃতিক এক আদুরে মায়া-মায়া পরিবেশে এ সম্প্রদায় বাস করছে বছরের পর বছর।

শুনলাম এখানে কোনো ওয়াশরুম নেই। প্রাতঃক্রিয়ায় এখানে ভরসা পাহাড়ের ঢাল এবং শুকরে। বিষয়টা বুঝতে দেরি হলো। খানিক পরে নিজেকে দেখলাম ঝিরি ধরে এগিয়ে যাচ্ছি, হাতে ফাঁকা পানির বোতল। ঝিরি থেকে পানি ভরে ঢুকে গেলাম এক পাহাড়ের ঢালে অবিরত সবুজে। গুল্মগাছ এদিক-সেদিক সরিয়ে নিজের বসার মতন একটা জায়গা করে নিলাম। শেষে উঠে আসতেই একদল শূকরছানা সেরে নিল তাদের সকালের আহার।

এখানের নিত্যদিন শুরু হয় ঘরের সামনে বাঁশ, কাঠের আগুন তাপানো দিয়ে। পরিবারের বড়-ছোট-বুড়ো সদস্যের পর নিজেদের উষ্ণ করে নেয় কুকুর, শূকর ও গয়াল পরিবার। পাহাড়ের কুকুরছানাগুলা বেশি আদুরে।

শীতের সকালের শরীর জমে থাকা ভাব কাটিয়ে উঠতেই এরা লেগে পড়ে নিত্যদিনের কাজে। বাজারের জন্য এ মানুষগুলো ৪-৬ ঘণ্টা হেঁটে যায় সেই দূরের আলীকদম বাজারে। এরা গয়াল পালে। সুযোগ এলো গয়ালের গোস খাবার। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে আর সুযোগ হলো না খাওয়ার। হেঁটে রওনা হলাম আমাদের পরবর্তী মুরং জনগোষ্ঠীর ‘মেনকিং পাড়া’র উদ্দেশে।

ঝিরি ফেলে, বিশাল পাহাড় ডিঙিয়ে যখন হাঁপ ছেড়ে বসলাম তখন আমাদের থেকে পাড়ের দূরত্ব ১০ মিনিটের। পথে ছোট ঝরনায় গোসল সেরে নেওয়া হলো। পানির ঠান্ডার তীব্রতা বুঝতেই আমি ফিরে আসলাম সে পথ থেকে।

পাহাড়ের খাঁজে এখানেও যখন বসলাম, চাঁদের অল্প আলোয় দেখছি কুয়াশা জমা রাতের পাহাড়ের সারি। বড় বড় গাছ, নতুন চিকন চাঁদ আর লক্ষাধিক তারার মেলা।

পাড়ায় রান্না শেষে খানিকক্ষণ বসে থাকলাম পাহাড়িদের নিজেদের গড়া ফায়ার প্লেসে। এদের রান্নাঘর ঘরের ভেতরেই। রাতে শুকনো কাঠ জ্বেলে রেখে ঘুমোয়, এতে ঠান্ডার তীব্রতা কম অনুভূত হয়। খাবার আইটেম বলতে আমাদের কাছে সুযোগ ৩ রকমের।

১. লাল চালের ভাত, পাহাড়ি দৈত্যাকার আলুর ভরতা, ডিম।

২. ভাত, আলু ভরতা, ঘন ডাল।

৩. ভাত, ডাল, মিষ্টি কুমড়ো ভাজি।

সকালে শুরু ক্রিসতং অভিমুখে যাত্রা। এই প্রথম ব্যাগপত্র সব পাড়াতে রেখেই কেবল নিজেদের নিয়ে যাত্রা শুরু। শতবর্ষী পুরোনো গাছের ছায়া, কড়া রোদ আর পাহাড়ের সবুজের মাঝে দিয়ে হাঁটছি আমরা। একটা সময় উঠে আসলাম আলীকদম থেকে ক্রিসতং মাটির রাস্তায়। শুনলাম, কোনো এক ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে এ রাস্তা করেছেন যেন কাঠবাহী ট্রাক যাওয়া-আসা করতে পারে। এমন এক ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম কিছু দূর। দেখলাম, ট্রাকে করে এনেছে টিন, বস্তা ভরা লবণ, চাল। আর তুলে নিয়ে যাচ্ছে হলুদ, মিষ্টি কুমড়ো। বিক্রি হবে শহরে। এ রাস্তার বদৌলতে শূন্য হচ্ছে পাহাড় প্রতিনিয়ত।

এক জুম ঘরে বসে পড়লাম সবাই। আড্ডা চলল বহুক্ষণ। মুরং প্রতিটি পরিবার দেখলাম স্বনির্ভরশীল। সবার ঘরেই আছে তাঁত, জুমের ফসল আর প্রকৃতির ঝিরি সমৃদ্ধ প্রাণ জুড়ানো অঢেল পানি। এই নিয়েই জীবন। নেই কোনো চুরির ভয়, নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছু। কাঠ সংগ্রহ করে পাহাড় থেকে। সাজিয়ে রাখে প্রতিটা উঁচু করে গড়া ঘরের নিচে। শূকর, কুকুরের থাকার জায়গাও এখানেই। শিকার করা হরিণের মাথা ঝুলিয়ে রাখে ঘরে। এটা নাকি ঐতিহ্য স্মারক।

স্বল্পবসনে লজ্জা, পর্দাবিহীন সুন্দর ও সরল জীবনের একটা দারুণ দৃষ্টান্ত দেখলাম এখানে। সকল পর্দা যে মনের, আলাপে তা বুঝলাম। এখানে জীবন যেমন সহজ তেমন সকলের প্রতি সম্মানবোধ অগাধ এবং নির্ভেজাল। ঝিরিতে গোসলে নামছেন প্রায় একেবারেই শূন্য দেহে। পাড়ার মানুষ, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সকলের চোখেই এটা স্বাভাবিক ও সুশ্রী। চোখের নগ্নতাকে এরা বিসর্জন দিয়েছে বহুকাল এবং বছরের পর পর এভাবেই জীবন ধারণে অভ্যস্ত এ সম্প্রদায়। সরল জীবনের এ ধারা বিমোহিত করল। নিজেরাই বরং লজ্জায় কাতর হয়ে উঠলাম-আমরাই কেবল এভাবে ভাবছি, অথচ পাহাড় উদার ও সভ্য। ..চলবে

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads