• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

রাজস্ব

সর্বনিম্ন পর্যায়ে রিজার্ভ

ইতিবাচক দেখছেন অর্থনীতিবিদরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০২২

বিপুল পরিমাণ আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন (৪ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারে নেমে এসেছে। যা গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এতো বিশাল অঙ্কের বিল পরিশোধ করা হয়নি। তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, আমদানি বাড়লে রিজার্ভ কমবে এটাই স্বাভাবিক।

সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৩ দশমিক ৫০ কোটি) ডলারের রেকর্ড আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ গত বৃহস্পতিবার ৪৪ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বর্তমানের আমদানির খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। অথচ তিন-চার মাস আগেও ১০ মাসের আমদানি খরচ মেটানোর রিজার্ভ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, মহামারি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর থেকেই দেশে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আগে মাসে আমদানি খাতে গড়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হতো। করোনার মধ্যে তা কমে গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানিতে উল্লম্ফন লক্ষ করা যায়। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সেপ্টেম্বরে তা গিয়ে ঠেকে ৭ বিলিয়ন ডলারে।

অক্টোবরে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয় ৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। সবশেষ নভেম্বরে তা প্রায় ৮ বিলিয়ন (৭.৮৫ বিলিয়ন) ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে।

অর্থনীতির বিশ্লেষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত আমদানি বাড়ার কারণেই রিজার্ভ কমছে। এ ছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের নিম্নগতি রিজার্ভ কমার আরও একটি কারণ বলে জানিয়েছেন তারা।

বেশ কয়েক বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। একের পর এক রেকর্ড হয়। মহামারি করোনাকালে আমদানিতে ধীরগতি আর রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে, যা ছিল অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। আমদানি বাড়ায় রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার চলে যাওয়ায় অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে তা ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। রপ্তানি বাড়ায় নভেম্বরের প্রথম দিকে রিজার্ভ খানিকটা বেড়ে ৪৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। ৭ নভেম্বর আকুর দেনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আকুর দেনা পরিশোধের পর ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। মার্চের শেষ দিকে তা আবার ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

২৮ এপ্রিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে রিজার্ভ। তবে ৪ মে আকুর আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ ফের ৪৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে। এক মাসেরও কম সময়ে ১ জুন তা আবার ৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। জুন শেষে সেই রিজার্ভ আরো বেড়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।

গত বুধবার আকুর ১৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই আকুর এতো বিশাল অঙ্কের বিল পরিশোধ করা হয়নি।

সবশেষ গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে আকুর ১১৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।

আর্ন্তজাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুত থাকতে হয়। গত অক্টোবর ও নভেম্বরে পণ্য আমদানি খরচের হিসাবে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে পাঁচ মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, করোনার ধাক্কা সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয় মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিও আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমদানিতে রিজার্ভ থেকে আগের চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি।

রেমিট্যান্সের ছয় মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ হাজার ২৪ কোটি (১০.২৪ বিলিয়ন) রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২১ শতাংশ কম।

তবে রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এই ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ২৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।

অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমদানি বাড়লে রিজার্ভ কমবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এখনও মোটামুটি সন্তোষজনক রিজার্ভ আছে। আর আমদানি বাড়া তো ভালো। এতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। কর্মসংস্থান বাড়বে।

তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন বেশি দিন থাকবে না। সেটাই হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, অনন্তকাল ধরে প্রবাসীরা বেশি অর্থ দেশে পাঠাবেন, এটার কোনো কারণ নেই। আর আরেকটি কথা আমি বলতে চাই, প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় না।

তার মতে, সত্যিকার অর্থে রেমিট্যান্স বাড়াতে আরও বেশি বেশি লোক বিদেশে পাঠাতে হবে; দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে। করোনার কারণে যারা দেশে ফিরে এসেছিলেন, তাদের দ্রুত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ভালো খবর হচ্ছে, রপ্তানি আয় বাড়ছে। এটা আগামী কিছু দিন অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads