• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ ডুবি, মুন্সিগঞ্জে বাড়ি বাড়ি শোকের মাতম

ছবি: বাংলাদেশের খবর

দুর্ঘটনা

১০ মাসের ব্যবধানে দুই দুর্ঘটনায় লাশ হলেন ৫৩ জন

শীতলক্ষ্যায় লঞ্চ ডুবি, মুন্সিগঞ্জে বাড়ি বাড়ি শোকের মাতম

  • মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৬ এপ্রিল ২০২১

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ১৯ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।এ নিয়ে গত ১০ মাসে দুটি পৃথক লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৫৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হলো। নিহতদের বাড়িতে বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

এ দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার রমজানবেগ এলাকার একই পরিবারের তিনজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের মধ্যে একজন বীথি বেগম(২৫),তার মেয়ে আরিফা (১) ও বীথির মা পাকিজা বেগম (৪০)।

সোমবার বীথিদের বাড়িতে চলছিল শোকের মাতম। বিকেলো ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটিতে শুয়ে বিলাপ করছেন নিহত বীথির ননদ রুপা ও জা জিয়াসমিন বেগম।

রুপা বলেন, আরিফার শরীরে এলার্জি দেখা দেওয়ায় তাকে রোববার বিকালে নারায়ণগঞ্জের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলন বীথি ও তার মা পাকিজা বেগম। পরে সন্ধায় তারা নারায়নগঞ্জের সাবিত আল হাসান লঞ্চে চড়ে বাড়িতে ফিরছিলেন। লঞ্চ ডুবে সবাই মারা গেলো।

সে বিলাপ করে বলেন, আমার ভাবি লঞ্চ ডুবে যাওয়ার পর হয়ত ভেবে ছিলো সে আর বাঁচবে না। তাই বুকের মনিকে বুকেই ধরেছিলো সে। যারা আমার ভাইয়ের বৌ আর ভাতিজির লাশ উদ্ধার করেছে তারাও এ দৃশ্য দেখে কেঁদেছে।

নিহত বীথি আক্তার রমজানবেগ গ্রামের আরিফ কাজির স্ত্রী। আরিফ তার একমাত্র মেয়ে আরিফা (১) ও স্ত্রী বিথী আক্তারকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ প্রায়।

একই ঘটনায় স্ত্রী সুনীতা সাহা, দুই সন্তান আকাশ সাহা(১২) ও বিকাশ সাহাকে (২২)হারিয়েছেন শহরের মালপাড়া এলাকার সাধন সাহা।

সাধন সাহা বলেন, স্ত্রী সুনিতা শাহা রোববার সকালে দুই ছেলে বিকাশ সাহা (২২) ও আকাশ সাহাকে (১২) নিয়ে ঢাকা জাতীয় চক্ষু ইন্সটিটিউট হাসপাতালে গিয়েছিল। আকাশের চোখের চিকিৎসা করাতে। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে শেষবার ফোনে জানিয়েছিল সাবিত আল হাসান লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ঘাট হয়ে মুন্সিগঞ্জ ফিরছে তিনজন। সাড়ে ৬ টার দিকে টিভিতে দেখলাম লঞ্চ ডুবেছে। এরপর থেকে স্ত্রী- সন্তানের মোবাইলও বন্ধ। রোববার রাতে স্ত্রীর মরাদরহ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে শেষ বিদায় করে এসেছি। সোমবার বড় ছেলের লাশ বাড়িতে এনেছি।ছোট ছেলের লাশ পেলাম মঙ্গলবার।

নিহত সুনিতা সাহার বড় বোন মনি সাহা সোমবার শ্বসানের মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে বিলাপ করছিলেন। বিলাপ করতে করতেই বলছিলেন,আমার বোনটা লঞ্চ উঠতে চাইত না। সব সময় বলত লঞ্চে উঠলে সেটা ডুবে যাবে। লঞ্চ ডুবে মারা যাবে।খুব ভয় পেত। লঞ্চের চড়লেও কখনো নিচে বসতে চাইতো না। ছেলেদের আবদারে লঞ্চে করেই মুন্সিগঞ্জের দিকে আসছিল। আমার বোনের ভয়টি সঠিক হল। জীবিত আর ফেরত আসলো না।

শোকের মাতম চলছিল উপজেরার চরডুমুরিয়া এলাকার সোলায়মান ব্যাপারি (৬০) ও বেবি বেগম (৫০) এর বাড়িতে।তারা দুজন স্বামী স্ত্রী লঞ্চ ডুবিতে মারা গেছেন। তাদের স্বজনরা জানান,সোলায়মান ব্যাপারির ফুসফুস ক্যানসার। চার দিন আগে তাঁকে কেমোথেরাপি দিতে ঢাকায় নেওয়া হয়। থেরাপি শেষে রোববার বাড়ি ফিরছিলেন। মেয়ে তাঁদের বন্দর থেকে লঞ্চে উঠিয়ে শেষ বিদায় দেন।

গত রোববার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সাবিত আল হাসান যাত্রীবাহী লঞ্চটি নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ যাচ্ছিল। লঞ্চটি মদনগঞ্জ এলাকায় নির্মাণাধীন তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি এসকে-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। এতে ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয় যার মধ্যে ১৯ জনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ ।

এদিকে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে নরভরে ছোটো লঞ্চ চলাচল করায় এবং নৌপথের ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা নদীতে সিমেন্ট কোম্পানির অসংখ্য জাহাজ যত্রতত্র রাখায় আক্ষেপ সেই সাথে আবারও দুর্ঘটনার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

মুন্সীগঞ্জ নাগরিক সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক অ্যাডভোকেট সুজন হায়দার জনি বলেন, রাজধানী ঢাকার সন্নিকটের জেলা মুন্সিগঞ্জ। দেশের সর্বোচ্চ আসন রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন এই জেলার মানুষ। কিন্তু আলোর নীচেই অন্ধকার। এই জেলার জনগণের ভাগ্য কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পরিবর্তন হয়নি। নৌপথে নারায়ণগঞ্জ হয়ে অথবা মীরকাদিম লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে সরাসরি ঢাকা যেতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু সেখানেও বিপত্তির শেষ নেই। এই দুই নৌপথও এখন সিন্ডিকেটের দখলে। একটি প্রভাবশালী লঞ্চ মালিক সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিনের পুরনো ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলো দিয়ে এই পথে যাত্রী পাড়াপাড় করছে। অপরদিকে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার দুই পাশে নদী দখল করে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসহ অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান। শিল্প মালিকরা এই নদীগুলোকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি মনে করছেন। নদী দখল করে শত,শত পণ্যবাহী জাহাজ নির্বিঘ্নে নোঙর করে রাখা হয় মুন্সিগঞ্জ-নারায়নগঞ্জ নৌপথে। এ কারণে নদীপথ সরু হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত ঘটে দূর্ঘটনা। এতো রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, এমপি, আমলা,নেতা থাকার পরেও আমাদের জেলা অভিভাবক শূন্য হয়ে আছে উচিৎ কথা বলার যেনো কেউ নেই।

মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ ঘাটের ইজারাদার দীল মোহাম্মদ কোম্পানি বলেন, মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথে ২৫টি লঞ্চ চলাচল করে। এর মধ্যে তেইশটি লঞ্চ ৪৫ থেকে ৫৫ ফুট দৈর্ঘ্যের। মাত্র দুইটি লঞ্চ ৬০ ফুটের উপরে। লঞ্চগুলো দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যাতায়াত করে। লঞ্চের আকার ছোট হওয়ায় প্রায় দুর্ঘটনা ঘটছে। লঞ্চগুলো আকার বড় করার জন্য বিআইডব্লিটিএ কে বারবার বলা হচ্ছে। তারপরও তারা বড় লঞ্চের অনুমোদন দিচ্ছেন না। সেই সাথে মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌপথের ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যার মোহনায় সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গুলো তাদের জাহাজগুলো যত্রতত্র অবস্থায় রেখেছে। যার ফলে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চগুলো চলাচল করছে। এতে করে যেকোনো সময় আবার ও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

এর আগে গত বছরের ২৯ জুন সকালে এম এল মর্নিং বার্ড নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। সে দুর্ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের ৩৪ জনের প্রাণহানী ঘটে।

দুর্ঘটনার পর ৩০ জুন সদরঘাট নৌ-পুলিশের এসআই শামসুল আলম বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।  

এ বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারী ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোয়াদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।এ মামলার এজাহারে দায়িত্বে অবহেলা ও বেপরোয়াভাবে মর্নিং বার্ড লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়ে প্রাণহানির জন্য ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, এক বছরের মধ্যে বড় দুটি নৌ-দুর্ঘটনা মুন্সিগঞ্জের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া ফেলেছে। সামনের দিনগুলোতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি আরো বলেন লঞ্চগুলোর আকৃতি বড় করতে বিআইডব্লিউটি কে বলা হয়েছে। এছাড়াও যারা নদীর মধ্যে যত্রতত্র জাহাজ রেখে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের লঞ্চ দুর্ঘটনায় মুন্সীগঞ্জের ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ১৩ জন পুরুষ ৬ জন।

দুর্ঘটনা কবলিত প্রতিটি পরিবারকে ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দাফন-কাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও এ পরিবারগুলোর অন্য যে কোন ধরণের মানবিক সহযোগিতা মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads