• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

তালগাছ বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করে

ছবি: সংগৃহীত

জীব ও পরিবেশ

বজ্র নিরোধক তালগাছ

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৪ মে ২০১৮

বজ্রপাতের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ও ঝুঁকি বেড়েছে। বিশ্বে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে উঠে এসেছে। আর এ কারণেই গুরুত্বহীন তালগাছের গুরুত্বও বেড়ে গেছে। কারণ তালগাছ বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গ্রামে-গঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারিকেল গাছ থাকলে বজ্রপাতে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। শক্ত-মজবুত গভীরমূলী বৃক্ষ বলে ঝড়-তুফান, টর্নেডো, বাতাস প্রতিরোধ এবং মাটি ক্ষয় রোধে তালগাছের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জনমনে প্রচলিত আছে- আগে বজ্রপাত হলে তা তালগাছ বা অন্য কোনো বড় গাছের ওপর পড়ত। আর বজ্রপাতের বিদ্যুৎরশ্মি গাছ হয়ে তা মাটিতে চলে যেত। এতে জনমানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। তাই বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই সরকারি উদ্যোগে ১০ লাখ তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, থাইল্যান্ডে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। ভিয়েতনামে টাওয়ার দিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমানো হয়েছে। সেই আদলে বাংলাদেশে হাওর এলাকায় তালগাছের পাশাপাশি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো- কষ্টসহিষ্ণু তালগাছ রোপণ করা খুবই সহজ। একটু মাটি খুঁড়ে আঁটি পুঁতে রাখলেই গাছ জন্ম নেয়। তালগাছ দীর্ঘকায় ও ডালপালা না থাকায় ফসলের বা চলাচলের পথে বাধা হয় না। পরিচর্যা না করলেও সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ, বেড়িবাঁধ, রেললাইন, পুকুর পাড়, খালের পাড়, নদীর পাড়, জমির আইল, পতিত জমি এমনকি বসতবাড়ির আশপাশের সীমানা তালগাছ রোপণের উপযোগী স্থান। তাল শাঁস গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ২০০৮ সাল থেকে প্রায় ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গায় ৩০ লাখের বেশি তালগাছ লাগায়। শক্ত-মজবুত আর দীর্ঘজীবী হওয়ায় শিশু, আম, জাম গাছের পরিবর্তে বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর, নওগাঁর পোরশা, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলার রাস্তার দুই পাশে লাগানো হয়েছে এসব তালগাছ।

শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়ে নয়, তালগাছ আমাদের অনেক উপকারে আসে। বাংলাদেশের সব স্থানে কম-বেশি তালগাছ চোখে পড়ে। তবে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে ভালো তাল উৎপাদন হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতে তালগাছ জন্মে। তালের রস শরীরের জন্য বেশ উপকারী। পাকা ও কাঁচা দু’ভাবেই তাল খাওয়া যায়। তালের রস দিয়ে তৈরি হয় তালমিছরি। ছোটবেলায় দেখতাম তালমিছরি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হতো। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলে গরমের তীব্রতা অনেক বেশি থাকায় বেশিরভাগ বাড়ি গরম ও জলবায়ু সহনশীল মাটি দিয়ে তৈরি হয়। জেনে রাখুন, মাটির বাড়ি তৈরিতে মূল উপাদান মাটির পরই তালগাছের কাঠের প্রয়োজন হয়। তালের কাঠে ঘুণ পোকা ধরে না এবং শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। তাই মাটির বাড়ির তীর, রুয়াসহ বিভিন্ন কাজে তালগাছ বহুল ব্যবহূত। তালগাছ থেকে যেসব উপকরণ তৈরি হয়- হাতপাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনি, চাটাই, ছাতা, ঝুড়ি, ব্রাশ, পাপোশ, ছোট বাস্কেট, মাছ ধরার চাঁই, লাকড়ি প্রভৃতি।

পুরুষ গাছের ফুল বা জটা হতে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড়, পাটালি, পিঠা, বড়া, লুচি, পায়েস ইত্যাদি তৈরি করা হয়। জেনে রাখা দরকার- কচি তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর, শরীরের পানিশূন্যতা ও ক্লান্তিহীনতা দূর করে, খাবারে রুচি বাড়ায়, লিভার সমস্যা, রক্তশূন্যতা, বমিভাব আর বিস্বাদ দূরীকরণে উপকারী। তাল কাঠের গোড়ার অংশ দিয়ে ডিঙি নৌকা তৈরি, ঘরের খুঁটি, আড়া, রুয়া, বাটাম, কৃষকের লাঙলের ঈষ তৈরি করা হয়। একটি তালগাছ উচ্চতায় ২০ থেকে ২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং ১৪০ থেকে ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তালগাছের মঞ্জুরির রঙ হলুদ, লম্বা আকৃতির। বসন্তে গাছে ফুল ধরে।

প্রকৃতির শোভা সুরক্ষায় সড়কের পাশে তালগাছ লাগিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন নড়াইলের লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা আল মাহমুদ ইরোজ। ১৯৮৫ সালে তিনি উপজেলার রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে তিন হাজার তালের বীজ রোপণ করলে দুই হাজার গাছ বাঁচে। ২০০১ সালে দুই হাজার বিচিতে এক হাজার ৩০০ গাছ, ২০১৩ সালে ১৫ হাজার বিচিতে আট হাজার গাছ বড় হতে থাকে। ধারাবাহিকভাবে বাড়ি বাড়ি থেকে তালের বীজ সংগ্রহ করে প্রতিবছরই নড়াইল, লোহাগড়া, লহুড়িয়া, কুন্দশী, পাচুড়িয়া, ইতনা-ধলইতলা, কাশীপুর, রাজপুর, কালনা ও কুন্দশী-মঙ্গলহাটা সড়কসহ লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে কমবেশি করে লাগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পরিবেশপ্রেমী এই মহান শিক্ষক ব্যাংকে স্ত্রীর সঞ্চিত ১ লাখ টাকাও তালগাছ লাগানোর পেছনে খরচ করেন। তিনি নিজ হাতে যত্নসহকারে গাছ লাগান এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। তালগাছের সুদিন ফিরিয়ে আনতে যশোরের কয়েক যুবক ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছেন। যার নেতৃত্বে রয়েছেন জেলার মনিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের হাসাডাঙা গ্রামের উদ্যমী যুবক নাঈম রেজা। এই যুবক পৃথিবীর বৃহত্তম তালের সারি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়কের ধারে তালের আঁটি রোপণ করেছেন। জানা গেছে, ২০১৪ সালে প্রথমে মনিরামপুর উপজেলার চিনেটোলা বাজার এলাকার ফকিরের রাস্তা থেকে রাজগঞ্জ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারের দু’পাশে ছয় হাজারের বেশি তালের আঁটি রোপণের মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু করেন। ২০১৫ সালে নিজ গ্রাম হাসাডাঙা থেকে কেশবপুরের মধ্যকুল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার পাশে ছয় হাজার তালের আঁটি রোপণ করেন। ২০১৬ সালে যশোর-রাজগঞ্জ-সাতক্ষীরা ৭৫ কিলোমিটার সড়কের দু’পাশে ১২ কিলোমিটারের বেশি অংশে ছয় হাজার তালের আঁটি লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। রাস্তার বাকি অংশে লাগানোর কাজও অব্যাহত আছে। তালগাছপ্রেমী নাঈম রেজার সহযোগিতায় আছেন তার বন্ধু সরোয়ার হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, আশিকুর রহমান, সোহেল রানা। জানা গেছে, এই যুবকরা রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের দু’পাশে গহের আলীর তালগাছের সারির ওপর প্রতিবেদন দেখে উদ্বুদ্ধ হন। নওগাঁ জেলার ভিমপুর ইউনিয়নের শিকারপুর গ্রামের শতোর্ধ্ব বয়সী গহের আলীর তালগাছ লাগানোর খবর ৩০ জানুয়ারি ২০০৯ জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারে। ভিক্ষুক বৃদ্ধ গহের আলীর সামর্থ্য নেই অন্য ফলদ বা দামি বনজ গাছের চারা কেনার। তিনি চাল-ডাল আর তালের আঁটি ভিক্ষে হিসেবে সংগ্রহ করে আঁটি পুঁতে দেন সরকারি রাস্তার দুই পাশে। প্রখর রোদে পথচারীদের কষ্টের কথা চিন্তা করে গহের আলী তালগাছ লাগানোর কাজ শুরু করেন। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের ভিমপুর ইউনিয়নের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে তালগাছগুলো তার সবই গহের আলীর লাগানো। ইত্যাদিতে প্রচারের পর সেই বছরেরই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিবেশ পদক-২০০৯ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গ্রহণ করেন। ২৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে তিনি বার্ধক্য রোগে মৃত্যুবরণ করেন। মানুষ ইচ্ছা করলে সমাজ ও দেশকে কতভাবেই না কতকিছু দিতে পারে। গহের আলী, আল মাহমুদ ইরোজ এবং নাঈম রেজার মতো হয়তো আরো অনেকেই নিভৃতে এমন সামাজিক কাজ করে চলেছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনে আবহাওয়ার বিপর্যয়ে প্রকৃতির নির্দয় প্রতিশোধ বজ্রপাত থেকে জানমালের রক্ষা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আসুন নিজ দায়িত্বে সবাই তালগাছ রোপণ করি।

এস এম মুকুল, বিশ্লেষক ও কলাম লেখক,

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads