• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বাজেটের আগেই বাড়লো দাম

সংগৃহীত ছবি

পণ্যবাজার

বাজেটের আগেই বাড়লো দাম

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ০৯ জুন ২০২২

মো. আশরাফ আলী খান। বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। স্বল্প বেতনে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার ছোট সংসার। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা। বাড়তি আয়ের কোনো পথ নেই তার। কিন্তু গত দুই বছর করোনার কারণে সংসার খরচ বেড়ে গেছে। এখন নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এদিকে অফিস থেকে প্রতিমাসে ঠিকমতো বেতনও দিচ্ছে না।

সবমিলিয়ে আশরাফ আলীর আয়ের সঙ্গে তার পরিবারের সব খরচ সামলাতে পারছেন না। প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন। আজ বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট পেশ হচ্ছে। বাজেটে নিত্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে কিনা এ নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত। গতকাল বুধবার তিনি বলেই, বেশ কিছুদিন ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। এখন সংসারের চাহিদা মেটাতে পারছেন না । অভাব কাটছে না। এই আয় দিয়ে ব্যয় সামলাতে পারছেন না। প্রতিমাসেই ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। বাড়ি ভাড়াও বেড়ে গেছে।

তিনি অভিযোগ করেন, যে সামান্য বেতন পাই তাও ঠিকমতো দিচ্ছে না। কি ভাবে বাসা ভাড়া দিব, কি ভাবে চলবো এ নিয়ে চিন্তায় মন স্থির রাখতে পারছি না। জীবনযাত্রার সব সেবা, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে। প্রায় সব খাতেই বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার মতো আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কমাতে হচ্ছে খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা। শুধু মো. আশরাফ আলী খানই নয়, তার মতো সারা দেশে হাজার হাজার নিম্ন ও মধ্যবত্তি শ্রেণি মানুষের সংসার পরিচালনা করা খুবই কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে।

সূত্র জানায়, করোনার সংক্রমণ কমার পর হঠাৎ করে চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের কারণে আন্তর্জাতিকসহ দেশীয় বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। আসন্ন বাজেট ঘিরে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতায় পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এ অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি মানুষের জীবন ধারণ খুবই সমস্য সৃষ্টি হচ্ছে।

বাজেট ঘোষণার আগেই গত এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ, চিকন চালের দাম সোয়া ৩ শতাংশ, আটার দাম ৯ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ৯ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ভোজ্যতেলে দাম লিটারে সর্বোচ্চ বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রতিকেজি আদা ১৫ শতাংশ ও রসুন ১৪ শতাংশ, গরু ও খাসির মাংসের দাম প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতিকেজি চিনির দাম ৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে।

প্রতিহালি ডিমের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮। এছাড়া জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে পরিবহন খরচ ও সেচ খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবজির দাম বেড়েছে গড়ে ৪ শতাংশ। এভাবে সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। গত এক মাসের ব্যবধানে তো আয় বাড়েইনি। গত এক বছরের ব্যবধানেও বাড়েনি। উলটো অনেকের আয় কমেছে। ফলে ভোক্তাদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে খাদ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপেও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগার তথ্য উঠে এসেছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ যে কতটা অসহায় তা একজন ভোক্তার বক্তব্য থেকে পষ্ট হয়ে ওঠে। রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. শফিউদ্দিনের (ছদ্ম নাম) সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আমার পরিবার। সেগুনবাগিচা এলাকায় থাকি। চাকরি করে বেতন পাই ৫৫ হাজার টাকা। এই বেতন দিয়ে গত দুই বছর আগেও পরিবার নিয়ে বেশ ভালো ছিলাম। কিন্তু এখন ভালো নেই।

বড় ছেলে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রতি সেমিস্টারে (৪ মাস) তার পড়ার খরচ ৩৫ হাজার টাকা। সেমিস্টারে ফির জন্য প্রতিমাসে সাড়ে ৮ হাজার টাকা করে রাখতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ ছেলেকে হাতখরচ দিতে হয় মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। মাসে যাতায়াত খরচসহ স্কুল ফি ৬ হাজার টাকা।

এর পর পরিবারের ৫ সদস্যের জন্য মাসে চাল দরকার ৩৫-৪০ কেজি। ৬৫ টাকা কেজি ধরলেও প্রায় ২৬০০ টাকা হয়। মাসের শুকনা বাজারসহ মাছ-সবজিসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে যায় ১০ হাজার টাকা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল চার হাজার টাকা। এতেই বেতনের টাকা শেষ। এরপর আছে আমার নিজের অফিসে যাতায়াত খরচ, চিকিৎসা, ছেলেদের বইখাতা-কলমসহ অন্যান্য ব্যয়।

বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। চাল থেকে শুরু করে ডাল এমনকি চিনি-লবণ পর্যন্ত বাড়তি দরে কিনতে হয়। পেঁয়াজ ও তেলের দাম আকাশচুম্বী। মাংস তো কেনাই যায় না। সবজির দামও অনেক। তাই যা জুটছে তা কিনে খেয়েপরে বাঁচতে হচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই। আজ বাজেটে ঘোষণা হবে। বাজেট ঘোষণার পর যেন কোনো নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি না হয় এই প্রত্যাশা করেন তিনি।

এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। সব মিলে এই দুই শ্রেণির মানুষের আয়ের সঙ্গে পরিবারের সব ব্যয় সামলাতে পারছে না। প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন। তিনিও নিত্যপণ্য মূল্য কমানোর দাবি জানান।

সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলকে অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসাবে অভিহিত করা হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও মানুষের জীবনযাপনে সবকিছুতেই জ্বালানি তেলের ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হু-হু করে বাড়ছে। গত আগস্টে ছিল প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার। এখন তা বেড়ে ১১২ ডলারে উঠেছে। জ্বালানি তেলের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পরিবহণ ব্যয় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সব ধরনের পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়েছে।

এদিকে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি তো আছেই। বিশ্ববাজারে এক মাস আগে প্রতিটন গমের দাম ছিল ২৩৫ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৭৮ ডলার।

একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিমুনাফা করার চেষ্টা চালায় বলে জানিয়েছেন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ

অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তিনি জানান, গত রমজান মানের সময় থেকে নিত্যপণ্য মূল্যের দাম বৃদ্ধি করেছে। তা এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান। আজ বাজেট ঘোষণা হবে। বাজেটের পরে নিত্যপণ্যের মূল্য যেন না বৃদ্ধি পায় সে ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমতে শুরু করেছে। যুদ্ধ শুরুর পর প্রতিটন চিনি ৪০৯ ডলারে উঠেছিল। এখন তা কমে ৩৯৬ ডলারে নেমেছে। আগে ছিল ৩৫০ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমলেও খুচরা বাজারে কমেনি। প্রতিকেজি ৮৫ টাকা দরেই বিক্রি হচ্ছে।

গত বছর এই সময়ে প্রতিকেজি ফার্মের মুরগি ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি। ডিসেম্বরে এক ডজন ডিম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৫ টাকা হয়েছে। বর্তমানে ১২০ টাকা ১২৪৫ টাকা। এছাড়া ডাল, ছোলা, মসলা, মাছ, মাংসের দামও বেড়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভোগ্যপণ্যের মধ্যে বিশেষ করে চালের দাম বাড়লে স্বল্প আয়ের প্রায় ১ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এ কারণে চালসহ ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়াটি টেকসই হবে না বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads