• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
চলনবিলে সুপেয় পানির সংকট চরমে

ছবি: বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

চলনবিলে সুপেয় পানির সংকট চরমে

  • নাটোর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০২১

নাটোরে চলনবিল অঞ্চলে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পশু-পাখি থেকে শুরু করে মানুষ আজ পানির জন্য অসহায় হয়ে পড়েছে। প্রমত্তা পদ্মা শুকিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। নদীর বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। সেই সঙ্গে পদ্মা সংযুক্ত প্রধান প্রধান শাখা প্রশাখা নদী বড়াল, আত্রাই ও গড়াই নদী অন্তত ৮৫টি নদী পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। শুকনো নদ-নদীতে চাষ করা হচ্ছে বোরো ধান। এসব নদীগুলোতে পানি না থাকায় মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছে। অপরদিকে এ অঞ্চলে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর। আগামী দিনে  এ নিয়ে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ নাটোর পাবনার চলনবিলের মধ্যে অবস্থিত ২০টির সবগুলো নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। আর অন্যদিকে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর। এতে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি জমিতে সেচ কার্যক্রম। এছাড়া যমুনা পদ্মা আত্রাই গুমানী ভদ্রাবতী কাঁসাখালসহ সব নদীর কোলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলে প্রায় ১০ হাজার মৎস্যজীবী বেকার হয়ে পড়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে নদীর পানি কমে গেলেও নদীর কোলের পানি তেমন একটা কমে না। কিন্তু এ বছর জানুয়ারির শুরুতেই পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সব কোলের পানিও প্রায় শুকিয়ে গেছে। তারা নদীর কোল খনন করার দাবি জানান। চলনবিলের পুঠিমারী গ্রামের কৃষক মোক্তার আলী জানান, গত বছর তার বোরিং-এ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট। এবছর সেখানে পানির স্তর ৩৬ ফুট নিচে নেমে গেছে। চৈত্র মাস আসতে না আসতেই শ্যালো এবং মোটরগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। দু-দফায় ১০ থেকে ১২ ফুট মাটির গর্ত করে পানির পাম্প নিচে দিয়ে বোরো জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও তেল খরচ বেশি হচ্ছে।

নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে জানা যায়, নারদ নদসহ  আত্রাই, বারনই, নন্দকুজা, বড়াল মুসাখাঁন, খলিশাডাঙ্গা, পঁচাবড়াল, গদাই, নাগর, এবং পদ্মা নদী (কিছু অংশ) এই ১১টি নদীর মধ্যে ৮টি নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে  পানীয় জলের সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। শুধুমাত্র নাগর ও আত্রাই এবং পদ্মার কিছু অংশে পানি রয়েছে।

নাটোর শহরের বাসিন্দা লেখক ও গবেষক খালিদ-বিন বাচ্চু বলেন, এটা আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এখনই প্রস্তুতি না নিলে আগামীতে সুপেয় পানির সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে।’

অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে খোলা জায়গা ও জলাধার কমে যাওয়া এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে অতিরিক্ত চাপের কারণে এই সংকট বলে মনে করেন তিনি।

নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি পানির সংকটে কথা স্বীকার করে বলেন, খরা মৌসুম এলেই আমরা নিরাপদ পানির সংকটে পড়তে হয়। এসময় পৌর এলাকায় অনেক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে গেছে। সরকার যদি পানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নদী থেকে দূষণমুক্ত পানি উত্তোলন ও প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগ না নেয়, তাহলে সামনে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।’

নাটোর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আলমঙ্গীর হোসেন জানান, চলতি অর্থ বছরে নাটোরে তিনটি প্রকল্পে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কাজ করছেন তারা। এগুলো হলো-সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ, পল্লী পানি সরবরাহ, অগ্রাধিকারমূলক গ্রামীণ পানি সরবরাহের কাজ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ৯০৪ টি সাবমার্সেবল পাম্পযুক্ত টিউবওয়েল, ৭৯টি সাধারণ টিউবওয়েল। জেলার ৫২টি ইউনিয়নে ৫২টি করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বরাদ্দ পেয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা ৫০টি পর্যন্ত। তবে অভিযোগ রয়েছে অধিকাংশ এসব সুবিধা ভোগ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ও  সরকার দলীয় জনপ্রতিধিরা।

সূত্র জানায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। দৃশ্যত মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে এগুচ্ছে এ অঞ্চলের সার্বিক আবহাওয়া। যা এ অঞ্চলের কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে রাজশাহীর তুলনায় নাটোর  জেলায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর তুলনামূলকভাবে ভালো। খরা মৌসুমে রাজশাহীর নিকটবর্তী পবা উপজেলায় ১৯৮৫ সালে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি। ১৯৯৫ সালে ৩০ ফুটের নিচে ও ২০১০ সালে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ ফুটে।

বরেন্দ্র নাটোর জোনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী  আব্দুল মতিন জানান, জেলার হাতিয়ান্দহ ইউনিয়নের আচলকোট মৌজায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে স্থিতিশীল পানির গভীরতা ছিল ১২ ফুট ২ ইঞ্চি, ২০১৪ সালের জুলাই মাসে পানির গভীরতা নেমে দাঁড়ায় ১৩ ফুট ১ ইঞ্চিতে। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় এক ফুট করে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।

বিএডিসি নাটোর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, জেলায় ২০০টি গভীর নলকূপ দিয়ে সেচের জন্য পানি উত্তোলন করা হয়। এসব নলকূপের প্রতিটার পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩০-৩৫ লাখ টাকা করে।  চলতি অর্থবছরে  ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নাটোর জেলায় ৮০ কিলোমিটার ইউপিভিসি পাইপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ সেচ নালা নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে  ভূ-উপরিস্থ পানির দিয়ে সেচ দেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, শ্যালো মেশিন মাটির ওপর থেকে ২৬ ফুট নিচ পর্যন্ত পানি তুলতে পারে। পানির স্তর অব্যাহত নিচে নামতে থাকলে একসময় শ্যালো টিউবওয়েলে পানি উঠবে না। সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে বিকল্প উৎস ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে সেচ কমিটির নীতিমালা মানার তাগিদ দেন তিনি ।  

রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহমুদা পারভীন জানান, ‘নাটোরসহ রাজশাহী অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে বোম-মোটর সংযুক্ত গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ফুট দূরত্বের মধ্যে একেকটি গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা। কিন্তু হোটেল মালিকরা মাত্র ৫০ ফুটের মধ্যেই একাধিক নলকূপ বসিয়েছে। এছাড়া নির্বিচারে গাছপালা ধ্বংস করা ও ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটার কারণে এ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূ-গর্ভস্থ পানির বিকল্প ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই। ভূ-গর্ভস্থ পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে, পুকুর, লেক বা নদী বৃদ্ধি করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে। অতিমাত্রায় পানি তুললে এই উৎসটি আর নবায়ণযোগ্য থাকে না। তাই অতিমাত্রায় পানি তোলা বন্ধ করতে হবে।  

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads