• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
কালীগঞ্জে খুদে আবিষ্কারক নাফিক

ছবি: বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

কালীগঞ্জে খুদে আবিষ্কারক নাফিক

  • টিপু সুলতান, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
  • প্রকাশিত ০৭ জানুয়ারি ২০২২

পরিত্যক্ত কাটুন, মোবাইল চার্জার ও কোমল পানীয় সেভেন আপের চারটি মুটকি দিয়ে তৈরি রিমোট কন্ট্রোল খেলনা মাইক্রো তৈরি করেছে। এমন মেধাবি শিশুর বিরল ঘটনার দেখা মিলেছে কালীগঞ্জ উপজেলার বড় ঘিঘাটি  গ্রামে। খেলনা গাড়ি সে নিজেই তৈরি করেছে। এসব দেখার জন্য প্রতিদিন এলাকার মানুষ তার বাড়িতে ভিড় করছে।

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের বড় ঘিঘাটি গ্রামের মৃত  লালটু বিশ্বাস ও রিনা খাতুনের ছেলে শাহারিয়ার নাফিজের কথা বলছি। সে বড় ঘিঘাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে এখন সুন্দরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। খুদে এই আবিষ্কারক নাফিজ জানায়, ইলেকট্রনিক যেকোনো জিনিস  তৈরির প্রতি বছর দেড়েক আগে থেকে তার প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পায়। তাদের এলাকার প্রতিবেশি বড় ভাই তামিমের একটি ইলেকট্রনিকের দোকান আছে স্থানীয় বাজারে। সে সেখানে গিয়ে ইলেকট্রনিকসের কাজ কিভাবে করে, কোন পার্টসের কি নাম, কোনটির কি কাজ শিখেছে।

হঠাৎ মাথায় আসল একটি ছোট ডামট্রাক বানাবে। তারপর যেই ভাবনা সেই কাজ। পুরাতন কাটুন, অব্যাবহূত সিরিঞ্জ, স্যালাইনের প্লাস্টিক সরু পাইপ, কোমল পানীয় বোতলের মুখ, পলিথিন, মোবাইলের পুরাতন ব্যাটারি ও চার্জের জন্য সকেট জোগাড় করে ছোট একটি ডামট্রাক তৈরি করে।

নাফিজ জানায়, প্রথম গাড়িটি যখন আমি বাড়ির উঠানের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে চালাচ্ছিলাম তখন আমার মনের মধ্যে অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করছিল।

ডামট্রাক বানানো শেষে নাফিজ শুরু করে রিমোট কন্ট্রোল মিনি মাইক্রো বানানোর কাজ। ডামট্রাক বানানোর উপকরণ সে এটি তৈরিতেও ব্যবহার করে। বাড়ির ব্যবহূত প্লাস্টিকের টিফিনবক্স ও ছোট ব্লেট ব্যবহার করে নাফিজ তৈরি করেছে একটি ব্লেন্ডার। তার তৈরিকৃত ব্লেন্ডারটিতে ছোট ছোট সবজি অনায়াসে কাটা যাচ্ছে। এ ছাড়াও সে সেভেন আপের দুইটি মুখ, ছোট  মোটর ও পাইপের সাহায্যে তৈরি করেছে পানির পাম্প। যে পাম্পের সাহায্যে পানি একপাত্র থেকে অন্যত্র উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে। খুদে এই আবিষ্কারকের ছোট ছোট আবিষ্কারগুলো নিয়ে তার গ্রাম, পাড়া ও মহল্লায় রীতিমতো শোরগোল দেখা দিয়েছে। কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া নিজ বুদ্ধি জ্ঞানে নাফিজের এই আবিষ্কারগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে বলে স্থানীয় অনেকেই মনে করেন।

এ ব্যাপারে নাফিজের মা রিনা খাতুন বলেন, নাফিজের বাবা স্ট্রোকজনিত কারণে যখন মারা যান তখন নফিজ প্রাইমারি স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়তো। স্বামী একটি মেয়ে ও একটি ছেলে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। হঠাৎ করে নাফিজের বাবা মারা যাওয়ায় সংসারে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তখন আমি বছর খানেকের  জন্য আমার বাবার বাড়ি তিল্লা গ্রামে বসবাস করতাম। পরবর্তীতে ছেলে মেয়ে নিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি বড় ঘিঘাঁটিতে ফিরে আসি। কিছুদিন পর থেকেই লক্ষ করি আমার ছেলে অব্যবহূত জিনিসপত্র দিয়ে ছোট ছোট গাড়ি, ব্লিন্ডার ও পানি তোলা পাম্প তৈরি করে। প্রথমে আমি তার কাজে বাধা দিলে সে তা শুনত না। এসব কিছু বানানোর প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। ছেলের এই মেধা দেখে মনের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়, তাকে লেখাপড়া পড়া শেখাব, একদিন সে দেশ সেরা ইঞ্জিনিয়ার হবে। নাফিজের মা ছেলের স্বপ্ন ভবিষ্যতের কথাগুলো বলতে বলতেই তার কণ্ঠস্বরে যেন একরাশ হতাশা স্পর্শ করল। লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন নাফিজের  লেখাপড়া ঠিকঠাকভাবে চালিয়ে নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমার নেই। বড় মেয়েটি দশম শ্রেণিতে পড়ে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ওর বাবার মৃত্যুতে আমার একার পক্ষে সংসার চালানো হয়ে পড়েছে কঠিন ব্যাপার। তার উপর আবার লেখাপড়ার এই বাড়তি খরচ। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানমনস্ক মেধা আমার ছেলের থাকলেও আমি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত। সমাজের বিত্তবান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ যদি আমার ছেলের পড়াশোনার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন তাহলে হয়তো বা সে একদিন প্রকৌশলি হয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারবে বলে আমি মনে করি। নাফিজের চাচা আনিসুর রহমান টোটন বলেন, আমার বাপ হারা এতিম ভাতিজার এ বয়সে অন্যদিকে মন না দিয়ে ইলেকট্রিক তথা বৈজ্ঞানিক ছোটখাটো জিনিস তৈরির প্রতি যে আগ্রহ আমি লক্ষ করেছি তা সত্যিই অনেক আনন্দের। মহান আল্লাহতালা তাকে যে মেধা দান করেছেন তার যথাযথ চর্চা ও পৃষ্ঠপোষকতা যদি করা হয় তাহলে সে নিশ্চয়ই একদিন বড় কিছু করতে পারবে। তাই আমি চাই সমাজের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ যদি এতিম এই শিশুর পড়ালেখার ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে সে পড়ালেখা করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। খুদে আবিষ্কারক ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া শাহারিয়ার নাফিজ জানাই, আমি লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে গাড়ি, বিমান ও হেলিকপ্টার তৈরি করতে চাই। আমি যা যা বানিয়েছি সেগুলো তো এখন  শুধু খেলনা। খেলা ছাড়া এগুলো আসলে কোনো কাজে আসে না, কিন্তু আমি চাই, আমি যে গাড়ি বানাবো তা রাস্তায় চলবে মানুষ চড়বে, যে বিমান ও হেলিকপ্টার তৈরি করব তা আকাশে উড়বে। আর এটা আমার স্বপ্ন। মানুষ স্বপ্ন দেখে, আর তার কর্ম স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেই। খুদে এই আবিষ্কারক নাফিজও স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নপূরণের হাতছানি এতিম এই শিশুর স্বপ্নকে কোনো একদিন হয়তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাই বাস্তবে রূপদান করবে।  জীবনে বড় হতে হলে বড় স্বপ্ন দেখতে হয়, আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতে হয়। এত ছোট বয়সে নাফিজের  নতুন কিছু সৃষ্টির আগ্রহ  এটাই বিশাল কিছু। শত প্রতিকুলতার ও প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে স্বপ্নপূরণের অগ্রযাত্রা একদিন নিশ্চয়ই খুদে আবিষ্কারক নাফিজ সফল হবে এমনটিই আশা আমাদের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads