• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
একীভূত শিক্ষা: প্রতিবন্ধী জাকী স্কুলে গিয়ে পড়েছে-গেয়েছে

ছবি: বাংলাদেশের খবর

সারা দেশ

একীভূত শিক্ষা: প্রতিবন্ধী জাকী স্কুলে গিয়ে পড়েছে-গেয়েছে

  • কাজী মফিকুল ইসলাম, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)
  • প্রকাশিত ২০ জানুয়ারি ২০২২

সকাল ১০টার পর ঘুম থেকে উঠা জাকীর প্রতিদিনকার নিয়ম। তাও আবার পরিবারের লোকজন তাকে বেশ ডাকাডাকি করে ঘুম থেকে উঠাতে হয়। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিসহ নতুন বই পাওয়ার পর স্কুলে যাওয়ার জন্য সে সকালেই ঘুম থেকে উঠে গেল। তরিঘড়ি করে নাস্তা শেষে স্কুলের জন্য প্রস্তুত। তখন ঘড়ির কাটা নয়টার ঘরে। মনে বেশ আনন্দ নিয়ে স্কুলে যায় জাকী।

অন্য দশজন শিশুর মতো না আট বছর বয়সি আব্দুল্লাহ মুবাশশির জাকী। হুইল চেয়ারে করে তাকে চলতে হয়। কথাও তার অস্পষ্ট। রয়েছে বুদ্ধির অপ্রতুলতা। কাগুজে ভাষায় প্রতিবন্ধী। তবে স্কুলে গিয়ে নিজের সামর্থকে ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করা জাকী অন্য সবার মতোই পড়েছে, গেয়েছে। জানিয়েছে, প্রতিদিন সে আসতে চায়। এখানে পড়তে চায়।

জাকীকে স্বজনরা মোহাম্মদ বলে ডাকেন। জাকী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের জাঙ্গাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের পাশেই তাদের নানার বাড়ি। সেখানেই তারা থাকেন। ১৪ জানুয়ারি স্কুলে ভর্তি হয়।

ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় জাকীর মা তাসমিমা নাহিদকে। জাকীর জীবন নিয়ে লড়াই, বছর পাঁচেক আগে স্বামী মঈন উদ্দিন চিশতীর মৃত্যুর পর নিজের জীবন নিয়ে সংগ্রাম করতে থাকার মানসিক শক্তিকে পুঁজি করে হাল ছাড়েননি তিনি। শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেকে ভর্তি করতে পেরে তিনি মহাখুশি। ছেলের জন্য সকলের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক তাসমিমা নাহিদ।

মূলত সরকারের একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম জাকীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সহায়ক হয়। একীভূত শিক্ষা হচ্ছে একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরীব, ছেলে-মেয়ে, প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধীসহ সকল শিশুকে একই শিক্ষক দিয়ে, একই পরিবেশে একসাথে মানসম্মত শিক্ষাদান করা। তবে সাধারনভাবে কোনো বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদেরকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয় না।

আখাউড়া উপজেলার জাঙ্গাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করানো হয়। গঙ্গাসাগর রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক পিছনের এর অবস্থান। পাশেই গঙ্গাসাগর নামে বড় একটি দীঘি রয়েছে। গ্রামীণ আবহে বেশ ছিমছাম পরিবেশ। স্কুলের ছোট্ট মাঠে কয়েক শিশুকে খেলতে দেখা যায়।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি নিয়ম অনুসারে মঙ্গলবার শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণির ক্লাশ হচ্ছে। সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে দেখা যায়, কখনো সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে কখনো নিজেই গান গেয়ে পড়াচ্ছেন শিক্ষিকা শারমীন আক্তার। আর এতে মাথা নেড়ে তাল মেলাচ্ছে জাকী। জানতে চাইলে এতে আপেল, বি তে বল- এটাও বলে সে। এ প্রতিবেদক শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে ক্লাশে প্রবেশ করতেই জাকীকে সালাম দিতে বলতে সে সাধ্যমতো হাত উঠিয়ে সালামের ভংগি করে।

ক্লাশেই জাকীর সঙ্গে ছিলো সম্পর্কে তার বড় বোন ইশরাত জাহান রিতু। হুইল চেয়ারে বসে লেখার সময় জাকীকে সহযোগিতা করছিলো সে। মাঝে মাঝে জাকীও সহযোগিতা চায়। রিতু দেশের গান গাইলে অন্যদের মতো মাথা নাড়িয়ে আনন্দ উপভোগ করে জাকী।

একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবন্ধী শিশু জাকীকে ভর্তি করাতে প্রথমে বেগ পেতে হয় তার মাকে। শারিরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আপত্তি করেন। কেউ কেউ মনে করতে থাকেন জাকী ভর্তি হলে তাদের সন্তানদের ক্ষতি হবে। আবার অনেকে মনে করেন জাকীর মা শিক্ষিত বিধায় তিনি আবার কি-না বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে বড় পদে চলে আসেন। সার্বিক পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকসহ অন্যরাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। জাকীর মা তার সহকর্মী রীনা দেবকে নিয়ে ছুটে যান আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রুমানা আক্তারের কাছে। বিষয়টি জেনে ইউএনও সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসের পাশাপাশি জাকীকে ভর্তি করতে নির্দেশনা দেন।

পরবর্তীতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূর জাহান বেগম, সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুর রহমান, মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির নেতা মৌসুমী আক্তার, মো. মাহতাব উদ্দিনসহ আরো অনেকের সহযোগিতায় ১৪ জানুয়ারি ভর্তি হয় জাকী। ওইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বই পেয়ে বেশ খুশি হয় জাকী। বাড়ি ফিরে পাড়া পড়শীকে স্কুলে ভর্তি হওয়ার খবর জানায় জাকী।

জাঙ্গাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষক আছেন চারজন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুবনা আক্তার, সহকারি শিক্ষক তাসলিমা আক্তার, শারমীন আক্তার, ফৌজিয়া আক্তারকে দেখা যায় জাকীকে পড়াশুনার কাজে সহযোগিতা করতে। জাকী স্কুলে ভর্তি হয়েছে বলে তাঁরা খুশি বলে জানালেন।

সহপাঠি আদি ঘোষ ও ফয়সাল জানায়, তারাও খেলবে জাকীর সঙ্গে। জাকীকে সময় দিবে। জাকী স্কুলে আসায় তাদেরও ভালো লাগছে। কথা বলার সময় ওই ক্লাশে উপস্থিত জনা ত্রিশেক অন্য শিক্ষার্থীও জাকীর সঙ্গে খেলবে বলে জানায়।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জাকীকে স্কুলে নিয়ে আসেন সম্পর্কে তার মামা সোহাগ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘বই পাওয়ার পর থেকেই জাকী খুব খুশি। আজ তো ডাক দেওয়া মাত্রই সে উঠে তৈরি হয়ে নেয় স্কুলে আসার জন্য।’

জাকীর নানী লুৎফা বেগম বলেন, ‘জাকীর বাবা মারা যায় প্রায় পাঁচ বছর আগে। এরপর থেকেই জাকী ও তার মা আমাদের বাড়িতেই থাকে। ছোট বেলা থেকেই জাকীর সমস্যা। ঘাড় সোজা করতে পারতো না। এরপর আরো নানা উপসর্গ দেখা দেয়। এখনো চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসরা বলেছেন তাকে যেন অন্যদের সঙ্গে মিশতে দেওয়া হয়। জাকী স্কুলে আসতে পেরে খুব খুশি।’

তিনি জানান, বাসায় বসেও সে পড়াশুনা করতো। মোবাইল ফোন দেখে দেখে অক্ষর শেখে। বাড়ির ও চেনাজানা অনেকে স্কুলে ভর্তি হলেও সে আসতে চায়। এখন সে ভর্তি হতে পেরে খুব খুশি। বারবারই বলছে যে সে পড়তে চায়। তাকে ভর্তি করতে পেরে আমরাও খুশি।

জাকীর মা কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার আমীর হোসেন জোবেদা ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক তাসমিমা নাহিদ বলেন, ‘ভর্তির বিষয়ে আমার কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আমাকে ছেলেকে ভর্তি করাতে পেরেছি তাতেই আমি খুশি। ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা এ কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন বলে।’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুবিনা আক্তার বলেন, ‘একীভূত শিক্ষায় সব কিছুর একসঙ্গে পড়ার অধিকার রয়েছে। আমাদের কাছেও খুব ভালো লাগছে জাকীর আগ্রহ দেখে। সব শিশুর সঙ্গে থাকলে জাকী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবে বলে মনে করি। আমরা সাধ্যমতো তাকে সহযোগিতা করবো।’

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘যেদিন জাকীকে বই দেওয়া সেদিন আমিও উপস্থিত ছিলাম। বই পেয়ে জাকীকে কি খুশি হয়েছিল সেটা বলে বুঝানো যাবে না। তার মাসহ পরিবারের লোকজনও এতে খুশি হয়। এভাবেই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুরা এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads