• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
কুষ্টিয়ার ৮টি নদী সংস্কার না করায় খালে পরিণত

গড়াই রেলব্রীজের নিচে গড়াই নদীর বর্তমান চিত্র

সারা দেশ

ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব

কুষ্টিয়ার ৮টি নদী সংস্কার না করায় খালে পরিণত

  • কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৯ মার্চ ২০২২

ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব, দখলবাজি আর সংস্কার না করার কারণে প্রায় মৃত বা শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে কুষ্টিয়ার ৮টি নদী। কিছুদিন পর মানচিত্র থেকেই হয়তো উধাও হয়ে যাবে নদীগুলো, মরুকরণ হবে ত্বরান্বিত, জীববৈচিত্রে পড়বে চরম প্রভাব। এমন মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের প্রধান নদী পদ্মা। জেলার দৌলতপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে এ নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পদ্মার অন্যতম শাখা গড়াই ও মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তিও এ জেলায়। ভারত পদ্মা নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় দেশের দীর্ঘ ও বড় নদী পদ্মা আজ হুমকির মুখে। ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি হলেও নানা অজুহাতে ভারত পানির ন্যায্য হিস্যা দিচ্ছে না। এতে নদীর অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে। নদীর কোথাও কোথাও এখন হাঁটু পানি। আর এরই প্রভাব পড়ছে গড়াই ও মাথাভাঙ্গা এবং এর শাখা, উপশাখা নদী ও বিল হাওড়গুলোর ওপর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ নদী দেশের উপকূলভাগে মিঠা পানির অন্যতম আধার। শুষ্ক মৌসুমে এ নদী শীর্ণকায় হয়ে পড়ে। ফলে উপকূলভাগ থেকে লোনা পানি উঠে আসে উজানের দিকে। এরই মধ্যে এ লবণাক্ততা মাগুরা জেলার মহাম্মদপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর জীববৈচিত্র রক্ষায় ১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়াই নদী খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। বর্তমান সরকার গত বছর থেকে আরো ১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়াই নদী পুনঃখনন প্রকল্প হাতে নিলেও তা কাজে আসছে না। শুষ্ক মৌসুম এলেই গড়াই পরিণত হচ্ছে মরা খালে। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ভাঙ্গার নদীর উৎসমুখ শুকিয়ে যায়।

এদিকে পদ্মা, গড়াই ও মাথাভাঙ্গার মতো বড় নদীগুলোতে দিন দিন পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হিসনা, কালী, চন্দনা, সাগরখালী ও কুমারনদী। হিসনা আর কুমার নদী দুটি এখন মাছ চাষের নামে স্থানীয় প্রভাবাশালীরা অসংখ্য বাঁধ দেওয়ায় এর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ক্ষমতাধররা নদীর দুপাড় দখল করে বাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ করেছে। আর হিসনার শাখা কুমার নদীর পুরোটায় চলে গেছে দখলদারদের পেটে। চন্দনা নদীর অবস্থাও কুমার নদীর মতো। সাগরখালি নদী খনন করে এর প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কুমার নদী গড়াইয়ের শাখা, এ নদীটি বিলীন হওয়ার পথে। বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে নদীটিতে। ঝাউদিয়া ও বৈদ্যনাথপুর বাজারসংলগ্ন এলাকায় নদীর বড় অংশ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর অর্ধেক অংশ শুকিয়ে পানিপ্রবাহ থেমে গেছে। বর্ষায় এসব নদীতে পানি থাকলেও তলদেশ ভরাটের ফলে শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ নদীতে পানি থাকে না। এসব নদীর বুকজুড়ে তখন চাষাবাদ হয়।

সরকারি এক হিসাব বলছে, কুষ্টিয়ায় নদ-নদী ও খাল-বিল দখলকারীর সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আবার নদ-নদী দখলের পাশাপাশি সমানতালে চলছে নদী দূষণের পাল্লা। কল-কারাখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদ-নদীতে। কোথাও কোথাও ড্রেনের সংযোগ এমনকি মলমূত্রও গিয়ে মিশছে এসব নদীতে।

কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার নদ-নদী ও খালের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত তিন হাজার দখলদার রয়েছে। ফলে নদ-নদী ও খালের প্রবাহ এখন আর স্বাভাবিক নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন পৃথকভাবে এসব দখলদারদের চিহ্নিত করেছে।

জেলার ছয়টি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া কার্যালয় সরেজমিন পরিদর্শন করে এ তালিকা তৈরি করেছে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কার্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, কয়েক বছর আগের করা এ তালিকার বাইরে বর্তমানে দখলদারদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া দখলদারদের তালিকায় রয়েছে পদ্মা নদী, গড়াই নদী ও কয়েকটি বিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় এসব নদ-নদীর বাইরেও দখলে রয়েছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের ছোট-বড় খালগুলো।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী, পদ্মা নদী, গড়াই নদী ও সেচ প্রকল্পের ছোট-বড় খাল দখল করে আছে অন্তত দুই হাজার ৯২১ জন দখলদার। বেশিরভাগই পাকা ও আধাপাকা টিনের বসতঘর। কোনো কোনো জায়গায় টিনের দোকান রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে দখল করে বাস ও ব্যবসা করে আসছেন তারা।

জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম বলেন, নদ-নদী ও খাল দখলকারীদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। যেকোনো উপায়ে নদ-নদী ও খালের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দিন জানান, করোনার কারণে দীর্ঘদিন ধরে জেলায় উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ রয়েছে। তবে খুব শিগগিরই এসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকাকে মরুকরনের হাত থেকে রক্ষা ও সুন্দরবনকে লবনাক্ত থেকে বাঁচানোর জন্য কুষ্টিয়ার নদীগুলোকে তার অতীত গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরী বলে পানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads