• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
নতুন শিক্ষানীতি আশীর্বাদ না অভিশাপ

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

নতুন শিক্ষানীতি আশীর্বাদ না অভিশাপ

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৫ জুন ২০২২

ড. শেখ মাহাতাব উদ্দিন

নতুন এক শিক্ষানীতির কথা শুনছি যার মূল পয়েন্ট হিসেবে ৬টি বিষয় প্রচার করা হচ্ছে— এক,  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুইদিন (শুক্রবার এবং শনিবার) বন্ধ থাকবে;  দুই, এসএসসি পর্যন্ত কোনো বিভাগ বা গ্রুপ থাকবে না; তিন, শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা; চার, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে আলাদা আলাদা পাবলিক পরীক্ষা হবে; পাঁচ, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, মূল্যায়ন হবে শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে; এবং ছয়, প্রাথমিকে পড়তে হবে আটটি বই, হাইস্কুলে দশটি।

অবশ্যই কিছু ভালো উদ্যোগ রয়েছে এখানে, অন্যভাবে বললে পশ্চিমা দেশের জন্য একটি আদর্শ ব্যবস্থা হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। কিন্তু আমরা বা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের জনজীবনের সাথে এই শিক্ষা কার্যক্রম কতটুকুন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে যদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়, তবে ল্যাবভিত্তিক বিষয়গুলোতে এভাবে দুইদিন বন্ধ রেখে মানসম্পন্ন শিক্ষা অসম্ভব। আমরা সপ্তাহে ৬ দিন ল্যাব করেও রসায়নের ল্যাবের শিক্ষা পরিপূর্ণ করতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করি না। সেই বিষয়গুলো কীভাবে ৫ দিনে পূর্ণ শিক্ষা বিতরণ করবেন তা আমাদের শিক্ষানীতি প্রণয়নকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। অপরদিকে এসএসসি পর্যায়ে বলা হচ্ছে দশটি বিষয় পড়ানো হবে, বিষয়গুলো হচ্ছে— এক, ভাষা ও যোগাযোগ; দুই, গণিত ও যুক্তি; তিন, জীবন ও জীবিকা; চার, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব; পাঁচ, পরিবেশ ও জলবায়ু; ছয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; সাত, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি; আট, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা; নয়, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা; এবং দশ, শিল্প ও সংস্কৃতি। 

এক থেকে সাত নম্বর পর্যন্ত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে। অপরদিকে নয় নম্বর বিষয়টি ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে একটি বিষয় এবং জানা যাচ্ছে, এ বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে না! একটি দেশ যেখানে প্রতিটি ধর্ম অনুসারীরা নিজেদের সাধ্যমত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে আগ্রহী সেই দেশে পাবলিক পরীক্ষা থেকে ধর্ম শিক্ষা বাদ দেয়ার মতো উচ্চমার্গের সিদ্ধান্ত কি আমাদের এই কমিটি স্থির বুদ্ধি বিবেচনা করেই নিয়েছেন? নাকি নিজেদের মনগড়া বিষয় জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিতেই এমন সিদ্ধান্ত? আমি যখন নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন তিনটি সুরা মুখস্থ করি যা মক্তবে মুখস্থ করানো হতো না। মুখস্থ করেছিলাম কেবল পরীক্ষাতে পাশের জন্য, এমনকি আমাদের ধর্মীয় শিক্ষকের কাছ থেকে ইসলামের অনেক নিয়মকানুন জেনেছিলাম কেবল পরীক্ষায় পাসের জন্য। কিন্তু ওই শিক্ষাই আজো আমাকে অনৈতিক কাজে বাধা দিচ্ছে, নামাজে আগ্রহী করছে, মানবতাবিরোধী কাজে আমার অনাগ্রহ সৃষ্টিতে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। আমাদের এই বিশেষজ্ঞ কমিটি কি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এ ধরনের কাজে বাধা দিতে চাচ্ছেন? যদিও বিষয়ের নাম দেয়া হয়েছে ‘নৈতিক শিক্ষা’! এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় দুনিয়ার বুকে ধর্ম ব্যতীত কোনো নৈতিক শিক্ষা কি গ্রীক মনীষীদের সময় থেকে অদ্য পর্যন্ত টিকে আছে? মানুষ কি তা মানে? মানলে কত শতাংশ মানে? উত্তরগুলো কি ভেবে দেখব? যদি কোনো এক গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে উত্তর দিতে হয়, তবে বলবো পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল ধর্মই মানুষকে নৈতিক শিক্ষাতে বাধ্য করতে পেরেছে। তাহলে ধর্ম শিক্ষার বইটির নাম বাদ দেয়ার উদ্দেশ্য এবং বাস্তবায়ন কি অঘটন ঘটন পটীয়সী সিদ্ধান্ত বললে অত্যুক্তি হবে কি?

অপরদিকে চার এবং নয় নম্বর বিষয়ের বিশদ অধ্যয়নের পরে আট ও দশ নম্বর বিষয়ের কি আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? একইভাবে যদি আট নম্বর বিষয়টির বর্তমান বইগুলো দেখি, তবে এখানে অবিবেচনাপ্রসূত বিষয়ের আবির্ভাব অভিভাবক মাত্রই বুঝতে পারেন। যে বয়সে যৌন অঙ্গ চিনতে পারার কথা, সেই বয়সে নিরাপদ যৌনমিলন শেখানোকে কীভাবে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক দিক থেকে বৈধ বলা সম্ভব? শিল্প এবং সংস্কৃতি নামক আমাদের সময়ে কোনো বিষয় ছিল না। অথচ আমরা নিকট বর্তমানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি শিল্প এবং সংস্কৃতি সচেতন। পশ্চিমা আগ্রাসনের মুক্ত পদযাত্রীদের কি এমন এক বিষয় দিয়েই আমরা বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক বানিয়ে ফেলব, যেখানে ওয়েব সিরিজ কিংবা নাটকের নামে নষ্ট সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের সন্তানদের মধ্যে আফিমের মতো ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাদের কিশোর এবং যুবাদের ওপর। সেই কিশোর এবং যুবকদের এমন অদূরদর্শী পাঠ্যবই ধরিয়ে দিয়ে আমরা কি সমাজকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতো সমাজ ব্যবস্থাতে নিয়ে যেতে চাই? যদি এটাই আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বলবো এই পাঠ্যবই ঠিকই আছে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের দেশের ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় সহাবস্থানমূলক বাঙালি সংস্কৃতি ধরে রাখতে চাই, তবে এই শিক্ষানীতির গুণগত পরিবর্তন অবশ্যই দরকার এবং তা এই নীতি ১% বাস্তবায়নের আগেই করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে দেশের মঙ্গলকামী শিক্ষাবিদরা একমত হবেন বলে বিশ্বাস রাখি।

অতএব আট এবং দশ নম্বর বিষয়ের পরিবর্তে বিজ্ঞান বিষয়ে একটি এবং ব্যবসা শিক্ষা বিষয়ের একটি পাঠ্যবই এই লেভেলে নিয়ে আসা অতীব জরুরি। সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়টিকে ছয় নম্বরে ভৌত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং আট নম্বরে জীববিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি দিয়ে স্থানান্তর করা হবে বর্তমানের প্রাণরসায়নের জয়জয়কার বিশ্বের জন্য উপযুক্ত একটি বেসিক শিক্ষা কার্যক্রম। অপরদিকে নয় নম্বর বিষয়ের পরিবর্তে হিসাব বিজ্ঞান কিংবা বেসিক ব্যবসাশিক্ষা বিষয়ক পাঠ্যবই নিয়ে আসলে এসএসসি’র পরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাও উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী হবে।

এবার আসি মূল্যায়ন পদ্ধতির পরীক্ষা ব্যতীত স্কুল নির্ভরতা প্রসঙ্গে। আমি যখন স্কুল লেভেলে শিক্ষকতা করতাম, তখন শিক্ষার্থীদের ব্যাচে পড়ানোর জন্য পরীক্ষাতে প্রশ্ন করা হলো ‘সে সড়সড় করে সুপারি গাছ থেকে নেমে গেল’ এই বাক্যের ইংরেজি করতে হবে! এরপর জানলাম শারীরিক শিক্ষা নামক বিষয়ের মূল্যায়ন স্কুলের শিক্ষকদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে প্রতিটি বাচ্চার কাছ থেকে ৩-৫ হাজার টাকা নিয়ে গ্রেড দেয়া হলো! অপরদিকে, কোরিয়া থেকে পিএইচডি ও পোস্টডক করা আমার বিভাগের এক শিক্ষক এক ছাত্রকে ১৩ মার্কে ২/৩ দিয়ে তাকে ৭৯ মার্ক দিয়ে গ্রেড সাবমিট করেছেন! কারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম ওই ছাত্র প্রেজেন্টেশন ও বাড়ির কাজে খুব ভালো করেনি। পরীক্ষায় যে ছেলে ৮৭ মার্কে ৭৫-৭৬ মার্ক পেল, ওই শিক্ষকের করা প্রশ্নে সেই ছেলে কীভাবে ১৩ মার্কে ২/৩ পায়? অনেক আলোচনা এবং শিক্ষককে কাউন্সেলিং করেও এই শিক্ষার্থীকে ৮০ মার্ক বা এ+ দেওয়ানো সম্ভব হয়নি। অথচ এটা শিক্ষকতার মৌলিক এবং নৈতিক দায়িত্বের একটি। এগুলো হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নের এবং শিক্ষকের বাস্তব অবস্থা। আর এরাই আমাদের শিক্ষকতা পেশার সিংহভাগ দখল করে রেখেছেন। এদের আপনি ট্রেনিং দিয়ে এমন সব অভ্যেস দূর করবেন? অসম্ভব, কারণ আমরা আমাদের শিক্ষকতা পেশাকে গত ৪-৫ দশক যাবত অবহেলা করেছি। শিক্ষকদের বেতন সেই সাহেবের কুকুরের চার ঠ্যাঙের এক ঠ্যাঙের সমান রেখে যেমন এই পেশাতে আইনস্টাইন পাওয়া অস্বাভাবিক, একইভাবে এই মহামারি আক্রান্ত শিক্ষক সমাজ দিয়ে জাপানের কিংবা সুইডেন-মানের স্কুল/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মূল্যায়নও অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। প্রথমত, স্কুলে বা কলেজে সর্বাধিক মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ এবং অনিয়মের বেড়াজালে জড়ানো শিক্ষক মুক্ত করতে হবে। শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কারিগর। সেই কারিগরদের নৈতিকতা বিশ্বমানের না হলে বিশ্বমানের পেশাজীবী, নাগরিক কিংবা মানুষ উৎপাদন অসম্ভব। বিশ্বমানের শিক্ষক নিয়োগ ব্যতিরেকে কেউ যদি এর সম্ভাবনা দেখেন, তবে তিনি আসলে তাসের ঘরে বসে রকেট লঞ্চিং করার ক্ষমতা সম্পন্ন রকেট শিক্ষাবিদ, যার দ্বারা জাতীয় জীবনে দুর্ঘটনা ব্যতীত কোনো শুভ কাজ আশা করা অবান্তর।

পরিশেষে বলবো, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের পলিসি তৈরিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রতিনিধি নিয়ে একটি বৃহৎ পরিসরের কমিটি গঠন করা প্রয়োজন ছিল। কারণ মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা না থাকলে কাগুজে জ্ঞান কেবল কাগুজে সিদ্ধান্তই নিতে সাহায্য করবে, যা জাতীয় জীবনে কোনো ভূমিকা রাখার যোগ্যতাই রাখবে না। বিশ্বাস না হলে, আগের শিক্ষানীতিগুলো কেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করেই দেখুন না, ফলাফল কি দাঁড়ায়। আমরা আমাদের বিভিন্ন (স্কুল বা কলেজ) পর্যায়ের শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে জানি না, অথচ আমরাই আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার মূল্য শেখাই। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কখনোই তৃতীয় শ্রেণিতে ক্লাস নিতে কী কী বিষয় মোকাবিলা করতে হয় তা জানে না। কারণ ওই লেভেলে তিনি শিক্ষকতা করেননি। যেমন— একজন বৈমানিক বিমান সম্পর্কে দক্ষ, তেমনি আমরা যারা বিভিন্ন শ্রেণিতে শিক্ষকতা করেছি, তারাই কেবল ওইসব শ্রেণির সমস্যাগুলোকে কীভাবে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করা সম্ভব সেই বিষয়ে জানি। তবে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে আবার স্কুলের সেই ‘সে সড়সড় করে সুপারি গাছ থেকে নেমে গেল’ মানের ভাষান্তর করতে দেয়া নৈতিকতাহীন শিক্ষকদের নিয়ে কমিটি করে কোনো লাভ হবে না। ফলাফল রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়, যা এই শিক্ষানীতিতেও হয়েছে।

সুতরাং সত্যিকারের একটি সোনার বাংলা গড়ার ইচ্ছা যদি আমাদের থেকেই থাকে, তবে একটি শক্তিশালী শিক্ষানীতি এই মুহূর্তে প্রণয়ন করতে হবে, যা আসলেই বাঙালি জাতিকে এবং তাদের মূল্যবোধকে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়ন করবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে কোনো একক গোষ্ঠীর কল্পনাপ্রসূত অবাস্তব শিক্ষানীতি আমাদের রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা আনয়ন ব্যতীত অন্য কোনো কাজে অদ্যাবধি সফল হয়েছে বলে আমাদের জানা নাই।

লেখক : শিক্ষাবিদ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads