• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

নির্বাচন

নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক ঐক্য!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

কোন্দলের কারণে দেশের রাজনীতি বেশ কিছুদিন ঝিমিয়ে ছিল। সম্প্রতি আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সব কোন্দল ভুলে নিজ দলীয় বা সমমনা দলগুলোর মাঝে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো এবং বিএনপিসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলো রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

প্রবীণ রাজনৈতিক নেতারা মনে করছেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল কেবল তাদের দলেরই ক্ষতি করছে না, বরং তৃতীয় শক্তির উদ্ভবের পথ করে দিচ্ছে। দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য বা গণতান্ত্রিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ঐক্য না এলে এর ফল জাতীয় রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ক্ষমতা এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থে এখন রাজনীতি খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।  

দীর্ঘদিন ধরে বড় দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোন্দল লেগেই আছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, সময় যত এগিয়ে আসছে ততই প্রকাশ হচ্ছে সেই জটিলতা। তবে আওয়ামী লীগে সেটা বেশি প্রকাশ হলেও বিএনপিতে চলছে খানিকটা নীরবে। দলীয় সব কর্মকাণ্ডে একটি গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানালে অপর গ্রুপ ওইসব অনুষ্ঠান বর্জন করে। ফলে বিপাকে পড়েছেন দলের মাঝারি পর্যায়ের ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও অনেকটা হতাশ।

বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো এখন মূলত সরকারবিরোধী একটি জাতীয় ঐক্য গড়তে চায়। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য সমমনা দলগুলোর সাথে ঐক্য। এ ঐক্য মূলত বিভাজনের ও ভোটের। রাজনৈতিক আদর্শের সাথে এ ঐক্যের সম্পর্ক নেই। ভোটের জন্য মূলত এটা এক রাজনৈতিক ঐক্য, আদর্শিক ঐক্য নয়।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ টানা এক যুগ ক্ষমতায় থাকলেও রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে স্থবির হয়ে পড়ছে দলের কার্যক্রম। স্থানীয় পর্যায়ে দলের মধ্যে প্রকট কোন্দল রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জার কর্মকাণ্ডকে ঘিরে। শুধু কোম্পানীগঞ্জেই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলটিতে কোন্দল প্রকট হয়েছে।

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে ‘কিছু পাওয়া না-পাওয়ার’ প্রশ্নে আওয়ামী লীগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বেড়েছে। তাই দ্বাদশ নির্বাচনের আগে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি করতে চায় আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক মহাজোট।

অন্যদিকে দলের ভেতর অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করতে এখনই উদ্যোগ নিতে চান বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। যারা রাজপথে থাকবেন তাদের মূল্যায়ন চান সকল শ্রেণির নেতা-কর্মী। সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মতামত দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেছেন, এ আন্দোলনে সফল হতে হলে প্রয়োজন দলীয় ঐক্য। এজন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে একই প্ল্যাটফরমে আনার পাশাপাশি রাজনৈতিক কূটনৈতিক তৎপরতাও বৃদ্ধি করেছে দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনকে অকার্যকর করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রবল দাপটের মুখে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়ে রয়েছে। সংসদে বিরোধী দল হিসাবে জাতীয় পার্টি থাকলেও তারা সরকারের অনুগত বলে মনে করা হয়। ফলে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে দলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বললেই চলে। সরকার এবং রাষ্ট্রে এই দল (আওয়ামী লীগ) বিলীন হয়ে গেছে। আর যেহেতু মাঠে কোনো প্রবল প্রতিপক্ষ দৃশ্যমান নেই, ফলে বাইরে থেকেও কোনো চ্যালেঞ্জ আসছে না। ফলে দ্বাদশ নির্বাচনের আগে দেশে আওয়ামী বিরোধী ঐক্য সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক।  

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব মনে করেন, একটি সুবিধাভোগী চক্র সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়ে রাষ্ট্রকে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জাতীয় সরকার গঠনকেই একমাত্র পথ হিসেবে দেখছেন তিনি। রব বলেন, এখন রাষ্ট্রের একমাত্র পথ হচ্ছে গণজাগরণের মাধ্যমে জাতীয় নৈতিক শক্তির পুনরুজ্জীবিত করা। এই পুনরুজ্জীবিত শক্তিই জাতীয় সরকার গঠন করবে। বিদ্যমান সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র বিকল্প হতে পারে জাতীয় সরকার গঠন। পুনরুজ্জীবিত শক্তি গঠন করতে প্রয়োজন হয়ে পরেছে দেশে বৃহৎ রাজনৈতিক ঐক্য।

এক সভায় আ স ম আবদুর রব বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনাব্যবস্থাকে একটি ‘অসাংবিধানিক’ ও ‘অনৈতিক’ জালিয়াতিচক্রে আবদ্ধ করা হয়েছে। এটি জাতিকে ক্রমাগত গভীরভাবে সংকটগ্রস্ত করে ফেলেছে। জাতিকে নৈতিকভাবে দেউলিয়ার শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহামুদুর রহমান মান্না বলেছেন, এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিরোধী দল নির্বাচনে নেই, তারপরও সরকারি দল নিজেদের মধ্যেই সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা ১৩ বছরে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ডাকাতি করে ক্ষমতায় গিয়ে তারা নির্বাচন ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। সামনে আর এমনটি হতে দেওয়া হবে না। ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনের জোরদার করে এ সরকারকে জাতীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দ্বাদশ নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হবে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের বলেছেন, দেশের  নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের অনেক ক্ষমতা আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা দৃশ্যমান নয়। নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সরকারি দলের সাথে অনেক সময় প্রশাসনের একটি অংশও জড়িয়ে পড়ছে। তাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে না।

জি এম কাদের বলেন, বিরোধী মতাদর্শের প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে দাঁড়াতেই পারছে না। মামলা-হামলা, ভয়ভীতি আর লোভ-লালসায় বিপর্যস্ত হচ্ছেন প্রার্থীরা। দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই বলে তিনি মনে করেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার অধীনে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিএনপির বিগত বৈঠকে এসব বক্তব্য উঠে এসেছে। সেখানে নেতারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলনের মতামত দিয়েছেন। কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে দ্রুত সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে ঐকমত্যে আসতে চায় দলটি। এ ক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে অটুট রেখে ডান-বামসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল, সুশীলসমাজ ও পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করছে বিএনপি।

কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্ত পরিবেশ বিরাজমান রয়েছে। কোনোমতেই বিএনপিকে আন্দোলনের নামে অরাজকতা করতে দেওয়া হবে না। রাজনৈতিকভাবে কঠোর হাতে তাদের মোকাবিলা করা হবে।

দল কোনো সংকটে পড়েছে, তৃণমূলে ঐক্য নেই এবং সরকার ও দল একাকার হয়ে গেছে-এসব বক্তব্য মানতে রাজি নন আওয়ামী লীগ নেতারা। কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দলীয় সরকার হলে কোনো পার্থক্য থাকার প্রয়োজন নেই। যেহেতু আমরা ১২ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়, সেজন্য আমাদের মধ্যে হয়তো নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার কারণে কোনো কোনো জায়গায় কিছুটা দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা কখনো ছিল না এবং এখনো নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads