• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

নির্বাচন

নির্বাচনে আস্থা ফেরানোর চেষ্টা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে ২০২৩ সালের শেষ অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে। এদিকে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাসহ বর্তমান কমিশনারদের মেয়াদ। এর আগে নতুন সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। এই নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। তাই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও নির্বাচনি ব্যবস্থাটি দেশে একটি স্থায়ী শক্তিশালী ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। নির্বাচন কমিশন গঠন ও ব্যবহার হয় বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায়। এজন্য বহুলাংশে দায়ী ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ক্রমেই অবনতির কারণে মানুষ নির্বাচন ও উদার গণতন্ত্র নিয়ে সংশয়ের মধ্যে রয়েছে। অপর দিকে আমলাতন্ত্রের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। ফলে নির্বাচনে ভোটারদের আস্থাহীনতা প্রকট আকার  ধারণ করেছে। নির্বাচনে সহিংসতা, ভোটের প্রতি আস্থাহীনতা-এমন সব সমস্যার সমাধানের জন্য ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র ওপর জোর দেন তারা।

এদিকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাচ্ছে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনসহ পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। তাদের মতে, মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে স্বাধীন, শক্তিশালী, কার্যকর ও অর্থবহ নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী নিবাচন কমিশন গঠনে একটি স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন বিরোধী নেতারা। সার্চ কমিটির মাধ্যমে না করে সব দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে সংলাপে বসে, সবার মতামতের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন তারা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনে ভোটারদের আস্থা অর্জনে গ্রহণযোগ্য পন্থায় নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। 

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতি শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। আর নির্বাচনে প্রস্তুতি হিসেবে সাংগঠনিক বিষয়গুলোর ওপর জোরাল পদক্ষেপ নিচ্ছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো।

বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ সংস্থাও বলছে, চলমান নির্বাচনগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা করা হচ্ছে না। বিএনপির দাবি, দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণের ভোটে মানুষের আস্থা নেই। বিএনপির ভোট বর্জনের সঙ্গে দেশের মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করছেন।

সুশীল সমাজ মনে করছে, ভোট এখন অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। মানুষ জেনে গেছে, ভোট দেওয়া এবং না দেওয়া একই কথা। সুষ্ঠু ভোটের ব্যবস্থার সক্ষমতা নেই নির্বাচন কমিশনের, তা স্বয়ং সংস্থাটির পক্ষ থেকেই গণমাধ্যমে খবর আসছে। আস্থার শেষ পেরেকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। আগামী নির্বাচনগুলোতে যদি আস্থা না ফেরাতে পারে তাহলে মানুষ স্থায়ীভাবে নির্বাচনবিমুখ হয়ে যেতে পারে।

সম্প্রতি দেশে ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ৯টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। ৪৩টি ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় লাভ করেন। বাকি ১১৭টিতে চেয়ারম্যান পদে ভোট হয়েছে। এ নির্বাচনে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট হওয়ায় আট ইউপিতে ৬৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ব্যালটে ভোট হওয়া ১০৯টিতে ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় প্রতীকে হওয়া এই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি অংশ নেয়নি। ইউপি নির্বাচন বিএনপি বর্জন করার পরও সহিংসতায় দুইজন নিহত হয়েছে। ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভোটকেন্দ্র দখল আর ব্যালট উধাওয়ের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয় ক্ষমতাসীন দলের একটি অংশ। বিএনপি নেই, দলীয় ভোটের নির্বাচনও রক্ত ছাড়া সমাপ্ত হয়নি। ক্ষোভ নির্বাচনে চোখ রাখা সংস্থাগুলোরও। আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসক বলছে, নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সকল পক্ষের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন অপরিহার্য। এনিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া নির্বাচন নিয়ে চলমান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব না। বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনে বহুদলের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের কারণ বিশ্লেষণ করে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য। ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতাও গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত।

তিনি বলেন, এই সব কিছুর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনা জড়িত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।

তার মতে, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোটের টার্ন আউট মোটামুটি ভালো ছিল, শতকরা ৬৯ দশমিক ৩৪ ভাগ। কিন্তু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ইউনিয়ন পরিষদে ৪৩ জন প্রার্থী নির্বাচন না করেই চেয়ারম্যান পদে অভিষিক্ত হওয়ায় এই নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে। অন্যদিকে ৯টি পৌরসভায় তিনজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন যেহেতু অনেকের মধ্যে বাছাই, সেহেতু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচিত হওয়া বলা যায় কি।

তিনি বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয়দিনের জন্য আমি ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করি। কয়েকজন সাংবাদিক ওই সময়ে অনুষ্ঠিত ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও ৯টি পৌরসভা নির্বাচনে আমার সাফল্য ও ব্যর্থতা জানতে চান। এমন সংক্ষিপ্ত সময়ে আকস্মিকভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। তারপরও কিছু কথা থেকে যায়। নির্বাচনে তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি সর্বদা বলে এসেছি জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়। তবু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ে সহিংসতা রোধ করা গেল না। নির্বাচনে ঘটনা বা দুর্ঘটনা যা-ই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনের ওপরই দায় এসে পড়ে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম বলেন, নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র সাংবিধানিক পথ। এটি রুদ্ধ হয়ে গেলে অশান্তিপূর্ণ ও অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা বদলের সুযোগ তৈরি হয়, এটি কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই আস্থার শেষ পেরেকে দাঁড়িয়ে গেছে নির্বাচন কমিশন।  এজন্য একটি নিরাপেক্ষ নির্বাচন কমিশন জরুরি। দ্বাদশ নির্বাচনের আগের ইসি আগামী নির্বাচনগুলোতে যদি আস্থা না ফেরাতে পারে তাহলে মানুষ স্থায়ীভাবে নির্বাচনবিমুখ হয়ে যেতে পারে। কারণ, ভোটারদের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তিনিই জয়ী হবেন। ফলে ভোট দিতে যাওয়া না যাওয়াতে কিছু আসে যায় না। ভোট এখন অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে।

নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সামরিক কর্মকর্তা  ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, গতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এবং ব্যাপক অংশগ্রহণ না থাকলে সে নির্বাচন যেমন বিশ্বাসযোগ্য ও অর্থপূর্ণ হবে না। তেমনি সে সরকার সত্যিকার প্রতিনিধিত্বমূলক হবে না। তাই নির্বাচন ও নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা মনে করি, সরকার জনগনের আস্থা তৈরির পথে হাঁটলে তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং দেশসুদ্ধ গণতন্ত্রের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। আইন, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা সব কিছু। ফলে মানুষের আর আস্থা ও আগ্রহ নেই নির্বাচনে। তাই আমরা নির্বাচনে থাকলেই বা কী আর না থাকলেই বা কী। এর ফল তো এখন দেখা যাচ্ছে।

ইসি পুনর্গঠন নিয়ে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনে কোনো আইন প্রণীত না হওয়ায় স্বাধীনতার পর থেকে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় সরকারগুলো জাতীয় নির্বাচনসহ সব নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে তাদের দলীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করেছে। বর্তমানে সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনের যে রীতি চালু আছে, প্রকৃতপক্ষে তা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সন্তুষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়। সুতরাং আমরা বলব, আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সরকারের এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা উচিত।

ইসি গঠনের জন্য আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেহেতু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রচলিত ধারায় নির্বাচন কমিশন গঠনের বিরোধিতা করছে, সেহেতু তাদের মতামতের প্রতি সম্মান রেখে ইসি পুনর্গঠনে স্বচ্ছতার দাবি করেন তিনি।

সংবিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্বাচন কমিশনকে সরকার সকল ধরনের সহযোগিতা করে আসছে দাবি করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আশাকরি, নির্বাচন কমিশন পরবর্তী ধাপের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আরো কার্যকর এবং কঠোর পদক্ষেপ নেবেন। গ্রহণযোগ্য সব পন্থায় এবারো নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads