• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
বই পঠন হোক উপলব্ধি বিকাশের উৎস

ছবি : প্রতীকী

সম্পাদকীয়

বই পঠন হোক উপলব্ধি বিকাশের উৎস

  • ইমানুল সোহান
  • প্রকাশিত ২৯ জানুয়ারি ২০১৯

‘বই’ শব্দটি ছোট কিন্তু ব্যক্তিজীবনে এর মর্মার্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বই মানুষকে হাসায়, কাঁদায় কিন্তু কখনো ছেড়ে যায় না। মানুষের চিন্তাশক্তির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয় বইপড়ার মধ্য দিয়ে। একটি জাতিকে স্বনির্ভর জাতিতে রূপায়িত করার জন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন। যে জাতির জনগোষ্ঠী যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি স্বনির্ভর, উন্নত ও সভ্য। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও গুণগত শিক্ষার হার বাড়ছে না; যার ফলে ক্রমাগত বেকারের হার বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে তরুণদের মাঝে বাড়ছে হতাশা। এর মূল কারণ হচ্ছে, আমরা শিক্ষাজীবনে যে বইগুলো পড়ি, সেগুলোর শিক্ষা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে দিনের পরিক্রমায় অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশ ও জাতি। এর মূলে রয়েছে পঠিত বইয়ের শিক্ষাকে ভুলে যাওয়া। জিপিএ-৫ অর্জন করাই এখন শিক্ষার প্রধান মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে শিক্ষার্থীটি মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ অর্জনে ব্যর্থ, সবাই তাকে অবমূল্যায়ন করে। একই সঙ্গে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগটিও সে হারিয়ে ফেলে। এটাই হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। যার ফলে দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়লেও সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে না।

সচেতন পিতা-মাতারা সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলে, ‘তোমাকে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।’ এই কথাটি দ্বারা পিতা-মাতারা সন্তানকে এটাই বোঝাতে চান যে, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ ও দেশের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া। এই শিক্ষাটি গ্রহণ করতে পারলেই সমাজ ও দেশের মধ্যে অসমতা দূরীভূত হবে। আর অসমতা দূরীকরণে ভূমিকা রাখে রাজনীতিবিদরা। দেশের রাজনীতিতে শিক্ষিতদের অংশগ্রহণ হ্রাস পাচ্ছে। এখন ব্যবসায়ীদের দখলে দেশের রাজনীতি। রাজনীতি করতে হলে জ্ঞানের কদরে নয়, টাকার প্রয়োজন। এটা একটি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। কারণ অসমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন বইয়ের পাতায় শিক্ষা দেওয়া।

মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় বই পড়ে কী হবে? কারণ পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় আঙুল ফুলে সহজেই ধনী হওয়া যায়। প্রথমত আমাদের দেশে যারা রাজনীতি করেন, তার কিছু অংশ বই পড়ে থাকেন। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৮৫ হাজারের বেশি বই আছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নাল ও সাময়িকী আছে। কিন্তু কতজন সংসদ সদস্য লাইব্রেরিমুখী? সংখ্যাটা হয়তো খুবই কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দশম সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যই একবারের জন্যই গ্রন্থাগারে যাননি। আর যারা গেছেন, তাদের অনেকেই পত্রিকা পড়ে চলে এসেছেন। আর সংসদ গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়েছেন মাত্র ৫৩ জন সংসদ সদস্য। বিষয়টি একটি জাতির জন্য হতাশাজনক। কারণ যাদের হাতে দেশের ঝান্ডা, তারাই বইবিমুখ। তারাই বইকে উপলব্ধি করেন না।

দ্বিতীয়ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে আসা প্রয়োজন। বর্তমানে পড়ালেখা মানেই পরীক্ষা। বাসা থেকে মুখস্থ করে এসে পরীক্ষার খাতায় তা ঢেলে দেওয়া। এর উদ্দেশ্য ভালো ফল নিয়ে বাড়ি ফেরা। তাহলে পড়ালেখার অর্থই কী ভালো ফল, না ভালো মানুষ হওয়া— এটা মীমাংসা করা দরকার আগে। হয়তো অবলীলায় বলবেন ভালো মানুষ হওয়া। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন তার সন্তানের জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি শিক্ষককে উদ্দেশ করে লিখেছিলেন, ‘বইয়ের মাঝে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, তাও তাকে বুঝতে শেখাবেন। বিদ্যালয়ে নকল করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক।’ কিন্তু আমাদের দেশের অভিভাবকদের চিত্রটি ভিন্ন। সন্তানকে জিপিএ-৫ অর্জনের জন্য অভিভাবকরাই অসৎ পথে গিয়ে ভালো ফল অর্জনের উৎসাহ প্রদান করে থাকেন। এর মূলে রয়েছে উপলব্ধিতার অভাব।

অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের খবর শোনা যায়। এটা কেন হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো সবই বোঝেন ও জানেন। এতকিছুর মূলে রয়েছে বইয়ের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হওয়া। যারাই বইয়ের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তারাই শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছেন।

কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষাগুরুর মর্যাদা নামক একটি কবিতা শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানো হয়। এই কবিতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কি দেয়? শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে দেওয়া উচিত। এই কবিতা শিক্ষা দেয়, শিক্ষকদের কীভাবে সন্মান জানাতে হয়। কিন্তু এই শিক্ষণীয় বিষয়টি আমরা কতটুকু আয়ত্ত করতে সমর্থ হয়েছি— প্রশ্নটি থেকেই যায়। কারণ হরহামেশাই পত্রিকায় শিরোনাম হতে দেখা যায়, শিক্ষককে পেটালো ছাত্র, ছাত্রের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত। এর মূলে রয়েছে পঠিত বইয়ের জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগে অসমর্থ হওয়া। যে শিক্ষার্থীটি বই পড়ে জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে, সেই শিক্ষার্থীর সমাজ ও দেশের মধ্যে মানুষের মতো মানুষ হয়ে সুনাম অর্জন করাটাই স্বাভাবিক।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে কবিতা, নাটক, গল্প ও উপন্যাস পড়ানো হয়। এসব পড়ার উদ্দেশ্য কি শুধুই আনন্দ দানের জন্য? কখনোই নয়। প্রত্যেক কবি, গল্পকার, নাট্যকার, সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক জীবনবোধের অবয়বে সাহিত্য রচনা করে থাকেন। তারা সমাজ ও দেশের অসঙ্গতিকে সাহিত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এসব বই অধ্যয়ন করে উপলব্ধি করতে হবে— কী শিক্ষা বা বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তা না হলে বইপড়াই বৃথা। উচ্চমাধ্যমিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী গল্প পড়ানো হয়। যে গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যৌতুক প্রথার কুফল সম্পর্কে সমকালীন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের বাস্তব চিত্রকল্পের আলোকে বর্ণনা করেছেন। সেই রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর মতো আজো দেশের কত হৈমন্তীকে যৌতুকের টাকা না দেওয়ায় দিনের পর দিন নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। কারণ রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী আমরা পড়েছি, পরীক্ষার খাতায় লিখে ভালো ফলও করেছি। কিন্তু এর শিক্ষাকে আমরা পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করিনি।

আরেকটি শিক্ষণীয় নাটকের কথা বলতে চাই। সেটি হচ্ছে গ্রিক লেখক সফোক্লিসের ইডিপাস নাটক। নাটকটি বইপড়ুয়া সব শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই পড়েছেন। এই নাটকে রাজা ইডিপাস নিয়তির পালাচক্রে নিজের বাবাকে হত্যা ও গর্ভধারিণী মাকে বিয়ে করে। এটা নিশ্চয়ই সমাজ ও দেশের চোখে জঘন্যতম কাজ। কিন্তু ইডিপাস সচেতনভাবে এই কাজটি করেনি। যখন এই কথাটি ইডিপাস জানতে পারল যে, সে নিজের বাবাকে হত্যা করেছে ও মাকে বিয়ে করেছে, তখন সে নিজের দু’চোখকে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধ করে দিল। অন্ধত্বের মাধ্যমে সে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে শুরু করল। কিন্তু ইচ্ছা করলে এটি সে নাও করতে পারত। কারণ তখন ইডিপাস রাজা ছিল। এই নাটক শিক্ষা দিচ্ছে, পাপ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু বিশ্বে বা আমাদের দেশে কয়জন নেতা এমনভাবে নিজেকে উপস্থিত করতে পারেন বা পারবেন? বলতে গেলে দৃষ্টান্ত নেই। সম্ভব হবে তখনই, যখন বইয়ের জ্ঞানে নিজেকে মূল্যায়ন ও উপলব্ধি করতে পারবে। তাই বলতে চাই, বই হোক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন ও ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগের অন্যতম মাধ্যম।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads