• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

একুশের চ্যালেঞ্জ এবং একুশের স্বপ্ন

  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০২০

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম

 

 

করোনাকালের চরম বিভীষিকার মধ্যেও ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে ঘূর্ণনের চলমান ধারায় ২০২০ বছরটা শেষ করে নতুন বছরে প্রবেশ করতে চলেছি আমরা। দুই হাজার একুশের নতুন বছরটি সারা বিশ্বের কাছে অধিক মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতিসহ বাজার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, প্রচলিত পরিবর্তিত আচরণ বিজ্ঞান তথা আচার-ব্যবহার বিষয়ে পরিবর্তিত মনস্তত্ত্ব, সেইসাথে শিক্ষাদীক্ষা ব্যবস্থার নতুন গতিধারা ইত্যাদি নানান বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবনার যেমন প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তেমনি কর্মশূন্যতার প্রভাবে সৃষ্ট বেকারত্ব মোকাবিলা করা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উৎকর্ষ সাধন করা বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জর মধ্য দিয়ে একুশ সালের পরিকল্পনা পরিচালনা ও সমন্বয়ের কাজটি করতে হিমশিম খেতে হবে সবাইকে।

২৫০ বছরের সুদীর্ঘ গণতন্ত্র চর্চার মধ্য দিয়ে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে যে চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করল, তাতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট খুব একটা সুন্দর চেহারা নিয়ে দুই হাজার একুশে প্রবেশ করছে তা বলার কোনো অবকাশই নেই। বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরূকরণ কিংবা মোড়লদের ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে যুক্ত হওয়ার যে প্রক্রিয়াটি রয়েছে, সেটি কোন পর্যায়ে গিয়ে তার চূড়ান্ত পরিণতি পাবে, বিষয়টি এত সহজে অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে একুশ সালে এসব ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে নানারকম অস্থিরতার রাজনীতি বিশ্ববাসীকে দেখতে হবে তা খুব সহজেই অনুমেয়।

আর চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক চিত্র এমনিতেই হতাশাব্যঞ্জক, সেইসাথে যুক্ত হয়েছে নতুন করে করোনা ভ্যাকসিন অর্থনীতির সুবিধা-অসুবিধা। এটি একুশ সালে গিয়ে কারো কারো জন্য অর্থনৈতিক আশীর্বাদ আর বেশিরভাগ মানুষের জন্য তা অভিশাপ বয়ে আনবে কি না তেমনটাই আশঙ্কা করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্বসভ্যতা শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান-গরিমায় যেসব দেশ বা পরাশক্তি এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করেন, সেসব দেশের নেতৃত্ব থেকেও যখন কাঙ্ক্ষিত কোনো মানবিক আশাবাদ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন তেমন আশঙ্কাটা বাস্তবে সামনে আসার সম্ভাবনাটাই খুব স্বাভাবিক। শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিশ্ব যে মাত্রায় উৎকর্ষ সাধন করেছে, ঠিক সে সময়ে এসেও ধর্মকেন্দ্রিক স্পর্শকাতর কথাবার্তা, কাদা ছোড়াছুড়ি, একে অন্যকে হেয় করে দেখা কিংবা নিজেকে ভালো মনে করে  অন্য সকলকে তাচ্ছিল্য করে দেখার যে প্রতিযোগিতা বিশ্ববাসী চর্চা করছে, তাতে একুশ সালে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করবে এমন কিছু আশা করার মতো ন্যূনতম সান্ত্বনা অন্তত এখনো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না। বিপরীতে, মাঝে মাঝেই যা দেখা যায় তা পরিণত রূপলাভ করলে ধর্মযুদ্ধ থেকে নতুন মাত্রায় বিশ্ব যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মহান সৃষ্টিকর্তা কার বেশি আপন তাই নিয়ে রক্তপাত দেখি এখনো। কারো বেশি আপন করে পাওয়ার প্রবণতার ক্ষেত্রে এমনিতেই অন্যদের ভাগ দেওয়ার মানসিকতার অনুপস্থিতি দেখা যায় বিধায় অন্যরা শত্রুতে পরিণত হয় খুব সহজে। এ সব কারণে-অকারণে শত্রুতার মাত্রা বাড়তে থাকে এবং শেষ পরিণতি প্রাণনাশী যুদ্ধে পরিণত হয়, যদিও মহান সৃষ্টিকর্তা সমগ্রের, কোনোভাবেই খণ্ডিতের নয়।

চলমান বিশ্ব বাজার ব্যবস্থার চরম ছন্দপতন ঘটেছে বিশেষ করে করোনাকালীন সময় থেকে এখনো পর্যন্ত নতুন করে বাজার ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি বরং চরম অবনতি হাতছানি দিচ্ছে তা আমরা ইতোমধ্যে অনুভব করতে শুরু করেছি। একুশের বছরটাতে এই বাজারব্যবস্থার অস্থিরতা কিংবা ভ্যাকসিন সংক্রান্ত নতুন বাজার যেহেতু সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য, কাজেই সে প্রয়োজনে এটার দখলদারিত্ব নিয়ে বছরটিতে বিশ্বমানবতা আবারো হোঁচট খাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুদ্রানীতিমালায় একটা বড় আকারের প্রভাব পড়বে যার ফলে কিছু আঞ্চলিক বাণিজ্য নতুন মাত্রা বা নতুন করে নিজেদের সাথে ব্যবসা বৃদ্ধি করার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশকে কেন্দ্র করে কম জনসংখ্যাসংবলিত কিছু কিছু দেশ বাজারব্যবস্থা এবং মুদ্রানীতির কারণে নিজেদের মধ্যে গাঁটছড়া বাঁধার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে ট্রেড এবং দেনা-পাওনার ভারসাম্য নিয়েও আন্তর্জাতিক অরাজকতা পরিলক্ষিত হতে পারে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ খাতের বর্তমান যে আগ্রাসন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো এমনিতেই খুব বেকায়দায় রয়েছে। একুশ সালে গিয়ে এটার মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দিতে পারে। সেখানেই হবে বড় রকমের একটা বিপত্তি। ছোটবড় ধনী-দরিদ্র সকলেই এটার ব্যবহার ছাড়া দৈনন্দিন জীবনে আর চলার স্বাভাবিক পথ আমাদের সামনে এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না। অন্তত করোনার প্রভাব যতটা দীর্ঘ হবে এবং নিরাময় ভ্যাকসিন যতটা বিলম্ব হবে, ততটাই বিপত্তি শুধু বাড়তেই থাকবে, কারণ অফিস-আদালত থেকে শুরু করে বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা চালিয়ে নিতে ডিজিটাল যোগাযোগের বিকল্প নেই। অন্যান্য কর্ম সম্পাদনের সাথে এমনকি খেলাধুলা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে প্রচলিত পথ ব্যবহারে নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে আসক্ত হচ্ছে।

ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এটা পরিপূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে এ খাতে মূল্য বৃদ্ধি পেলে আর পরিবারের আয় করা মানুষটির আয় কমে গেলে কিংবা বেকারত্বের মুখোমুখি হতে হলে বড় আকারের হতাশা দেখা দেবে, এমনকি শেষ পর্যন্ত সামাজিক পরিবেশে এটার বিরূপ প্রভাব পড়বে আর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর বড় আকারের চাপ তৈরি হবে, যা সামাল দেওয়া খুব সহজ হবে না। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকেন্দ্রিক তর্কযুদ্ধের এই অশুভ পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিশ্ব হাঁটতে শুরু করলে অনিবার্যভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা ধরে রাখাই হবে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। চলমান সময় শিশু-কিশোর-যুবক শ্রেণির মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বিশ্বের কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা কিংবা আমাদের মতো দেশগুলোর নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা এখনো খুব বেশি পরিষ্কার বা দৃশ্যমান না হওয়ায়, করোনার প্রাদুর্ভাব এবং এ সংক্রান্ত ভীতি জয় করে এ শ্রেণির মনস্তত্ত্ব ও মনুষ্যত্ব বিকাশে কার্যকর কোনো বাস্তব পদক্ষেপ একুশ সালে নেওয়া সম্ভব না হলে বিকারগ্রস্ততা যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি আচরণে দেখা দেবে বড় ধরনের পরিবর্তন, যা মোটেই শুভকর হবে না।

কিছু একটা হতাশাব্যঞ্জক মনে হওয়ায় জনৈক বন্ধুর সাথে আলাপচারিতা করছিলাম। একপর্যায়ে ও আমাকে একটা সুযোগ করে দিল এমনটা বলে যে, যদি একটা সুযোগ এ মুহূর্তে দেওয়া হয় তাহলে একুশ শতকের একুশ সালের প্রথম প্রভাতে কী ধরনের বিশ্বযাত্রা দেখলে তোর স্বপ্ন ছুঁতে পারে বলতে পারিস? আমার স্বপ্ন তো পৃথিবীর সকল মানুষের সমন্বিত স্বপ্নের সমান। আমি তো সকলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে ফিরি সারা দিন আর নিজের মধ্যে সবার অংশগ্রহণকে নিবেদিত করতেই কাটে আমার সারাক্ষণ। এমন যদি হতো- একুশের প্রথম প্রহরে সরল সাদা মনের একটা মানুষকে শুভ সকাল জানানোর পর এক কাপ চা খেতে খেতে নিচের অনুস্বপ্নগুলোর ঘোষণা শুনতে পারতাম! বিশ্বরাজনীতির ভেদাভেদ শেষ করে বিশ্বমানবের কল্যাণে সকলেই একমতে এসে প্রতিশ্রুত কাজের দৃশ্যমানতা যাত্রা শুরু করেছে। করোনা ভ্যাকসিন বাজার ব্যবস্থা ধনী-গরিব সকলের জন্য সমান সুযোগ অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতিবিদ একমত পোষণ করে সর্বজনীন একটি নীতিমালা তৈরি করে পৃথিবীর অর্থনীতি পরিচালনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করত, ন্যূনতম ব্যয়ে বিশ্বের সকল মানুষ তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগব্যবস্থার সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ পেত, পৃথিবীর সকল ধর্মের বড় বড় প্রজ্ঞাবান জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সমাবেশ থেকে মহান সৃষ্টিকর্তাকে একই অনুভূতি দিয়ে সবাই অনুধাবন করতে অনুপ্রাণিত হতো। বিশ্ব মনস্তাত্ত্বিকদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে মানুষ মানুষের প্রতি প্রায় একই ধরনের আচরণ ও ব্যবহার করতে শিখত। আন্তর্জাতিক থেকে শুরু করে দেশীয় রাষ্ট্রপরিচালনা ও সামাজিক পারিবারিক থেকে ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত যদি ঠকবাজিতার অস্তিত্ব থাকবে না মর্মে আমরা সকলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি। নারী-শিশু-বৃদ্ধ আর বিশেষ শিশুরা সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পেয়ে জীবন ধারণ করবে। প্রকৃতি ও পরিবেশ মানব জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে মানুষ মেনে চলছে। সৃষ্টি সত্তার অন্যান্য প্রাণিকুল মানুষের ভালোবাসা পেয়ে জীবন ধারণ করছে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় আর কোন বাধা নেই এখন থেকে।

তবে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সহজাত কারণেই আমরা আজো স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। কোনো এক বিষাদময় গোধূলিতে একাকিত্ব ভরা বিশেষ একটি মুহূর্তে হঠাৎ করেই আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল একটিবারের জন্য হলেও এমন কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী হতে, যা দিয়ে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী পুরো পৃথিবীর বর্তমান অবস্থাটাকে আমূল বদলে দিতে পারি! কেমন হতো, যদি আগামীর প্রথম সকালটিতেই দেখতে পেতাম বৃহৎ দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি পাল্টে গেছে। তারা এখন থেকে পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য অধিকতর মানবিক।

যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যেত, যদি থেমে যেত ধর্মীয় ভেদাভেদ, প্রতিটি শিশুকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সমান সুযোগ দিয়ে সুপরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে সুনাগরিক তৈরি করা হচ্ছে, যদি প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করা হতো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায়, যদি মানুষ বন্ধ করে দিত অস্ত্রের মহড়া, যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব থাকত রাষ্ট্রের ওপর, শিল্পের চর্চায়, মানবিকতার বিকাশে, সহজ সরল করে পরিবেশবান্ধব একটি সুন্দর পৃথিবী যদি আমরা এই একুশেই উপহার দিতে পারতাম পরবর্তী প্রজন্মকে!

 

লেখক : পুলিশ সুপার, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads