• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী কথাই সৃষ্টি করে ইতিহাসে প্রথম বাঙালির রাষ্ট্র

  • প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০২১

আবদুল মতিন খান

 

 

মুখ দিয়ে যে শব্দ বের হয় সেটাই কথা। জীবজন্তু, পাখ-পাখালি, কীটপতঙ্গ এমনকি অনেক অণুজীবেরও মুখ দিয়ে শব্দ বের হয়। শব্দ বের হলেই যে সেটা কথা হবে তা বলা যাবে না। কথা হতে হলে তাকে ভাব পৌঁছে দেওয়ার উপযোগী হতে হয়। মানবেতর যাবতীয় প্রাণী যে শব্দ করে, তার অর্থ সীমিত। সীমিত হওয়ার কারণ তার মনের ভাব সীমিত। ফলে তাদের কথার বিকাশ হয়নি, এক জায়গায় থেমে আছে। কথার বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটেছে শুধু মানুষের। মানুষকে এজন্য বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা।

পৃথিবীতে মানুষ প্রায় সর্বত্র আছে। ঊষর মরুতে যেমন আছে, তেমনি আছে হিমশীতল বরফের দেশে। বাসস্থানের বৈচিত্র্য অনুযায়ী গঠিত হয়েছে তার জীবনযাপন প্রণালি। মানুষের মধ্যে আছে অনুসন্ধিৎসা। আছে যেমন আছে তার থেকে ভালো থাকার চেষ্টা। সম্মিলিতভাবে ছাড়াও দু-চারজন মানুষের এ চেষ্টা আছে ঢের গভীর। বলতে গেলে কতিপয় এসব ব্যতিক্রমী মেজাজের মানুষের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে আজকের মহাকাশ যুগের সভ্যতায় পৌঁছা। মনের ভাবকে কথায় রূপান্তরিত করে তাকে রূপে দেওয়ায় মানুষের সহায়ক হয়েছে তার হাত এবং পা। অনেক প্রাণীরও হাত-পা আছে, যেমন বানর গেরিলা শিম্পাঞ্জির। কিন্তু তাদের পা মুক্ত না হওয়ায় হাত দিয়ে কিছু তৈরি করতে পারে না। হাত দিয়ে কিছু তৈরি করতে হলে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে সক্ষম হতে হবে। একমাত্র মানুষ ছাড়া আর কারো এ অবস্থা নেই।

হাত মুক্ত হওয়ায় মনের ভাবনা মানুষ হাত ব্যবহার করে বাস্তবায়ন করে। মানুষ দেখতে পায় অস্ত্র বা যন্ত্র কাজ দ্রুত করার জন্য ও অধিক ভোগ্যবস্তু তৈরিতে সহায়ক। এটা একবার বুঝে ফেলার পর তার কাজ হয় অস্ত্র উন্নতকরণ আর নতুন ভোগ্যপণ্য অধিক সংখ্যায় ও পরিমাণে উৎপাদন। বিগত কয়েক লক্ষ বছরে এ প্রচেষ্টায় মানুষ আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে চোখ মেললেই দেখা যায়, বলার দরকার করে না। মানুষের এ অর্জনে মূল সহায়ক শক্তিরূপে কাজ করেছে কথা এবং তার বিকাশ। নতুন যন্ত্র ও নতুন দ্রব্য প্রস্তুত হয়ে গেলে তার পুরো প্রক্রিয়াটার সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে কথায় লিপিবদ্ধ করে। লক্ষ বছর আগে যে মহাবিজ্ঞানী পাথর ভেঙে ধারালো অস্ত্র তৈরি করেছিলেন, তিনিই হলেন আজকের রেলওয়ে, মোটরযান, বিমান, রকেট ও মহাকাশ যানের আদত পথনির্দেশক। আজকের দুনিয়ায় একটি দেশের মর্যাদা ও উন্নয়ন প্রকাশ করা হয় উৎপাদনে যন্ত্রের ব্যবহার ও তার সফল প্রয়োগ দেখে। বাংলাদেশ যে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীলে উঠে গেছে, তার কারণ ওটাই। বাংলাদেশে যন্ত্রের ব্যবহার এখন সর্বত্র।

যন্ত্রের ব্যবহার তো আপনাআপনি বাড়ে না। যন্ত্রকে কোন কাজে লাগাতে হবে সেটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ একসময় বিপুল খাদ্যঘাটতির দেশ ছিল। উত্তরবঙ্গে ছিল চিরস্থায়ী মঙ্গা। এর পেছনে ছিল সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত। তারা বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতিতে রেখে অর্থাৎ মানুষকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ফেলে তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্য দিয়ে সে ঘাটতি মিটিয়ে এ দেশের মানুষকে জিম্মি করে রাখত। বাংলাদেশ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারা খাদ্যবাহী জাহাজ মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি করে এবং তাতে তখন তিরিশ হাজার বাঙালি না খেয়ে অক্কা পায়। সাম্রাজ্যবাদ অর্থাৎ দুর্বলকে তাঁবে রাখার এটাই হলো হূদয়হীনদের কৌশল। এদের কথা কখনো বিশ্বাস করতে নেই। স্তোকে নেই ভুলতে।

বাংলাদেশের মতো সুজলা সুফলা উর্বর মাটির দেশ এ অবস্থা থেকে অর্থাৎ দুর্ভিক্ষ ও মঙ্গা থেকে বেরিয়ে এসে এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেবল ভাতে নয়, মাছেও বাংলাদেশ আজ উদ্বৃত্ত। মাছ উৎপাদনে তার অবস্থান আজ পঞ্চম। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মাছ আজ রফতানি হয়। বয়নশিল্পে বাংলাদেশ সুপ্রাচীনকাল থেকে সারা বিশ্বে নন্দিত। প্রাচীন পৃথিবীর সকল দেশের বণিক বাংলাদেশ থেকে মসলিন, জামদানির মতো সূক্ষ্ম বস্ত্র ছাড়াও পপলিন ব্যালিকো প্রভৃতি উন্নত সুতিবস্ত্রও আগাম দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যেত। সেই বস্ত্রশিল্পের চরম সর্বনাশ ঘটে দেশ বিদেশির দখলে গেলে। সে অবস্থা কাটিয়ে বাংলাদেশ এখন চরম সাম্রাজ্যবাদী বৈরিতা কাটিয়ে বস্ত্র উৎপাদন ও রফতানিতে উচ্চ আমদানি কর দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েও শক্ত স্থান করে নিয়েছে। তাঁত বস্ত্রতেও বাংলাদেশ প্রসিদ্ধ। তাঁত বস্ত্রের রফতানিও বাড়ছে দিন দিন।

কথা ছাড়া কিছু হয় না। এজন্য কথা ভালো করে শেখা দরকার। দরকার ভালো করে বলা। যে ব্যক্তি এ কাজটি পারেন, তিনি দ্রুত যান এগিয়ে। যার ভাষাজ্ঞান দুর্বল, উচ্চারণ বিকৃত- সে কখনো কিছু ঠিকমতো বলতে পারে না। বিদ্যালয়ে প্রণালিবদ্ধভাবে ভাষাসহ সব বিদ্যা শেখানো হয়। সাধারণত মাতৃভাষায় বিদ্যালয়ে পাঠদান করা হয়। মাতৃভাষা বলেই যে মাতৃভাষা মনোযোগ না দিয়ে শিখতে হবে সেটা ভুল। মাতৃভাষা হলো মুখের ভাষা, যা জন্মের পর মা-বাবা ও নিকটজনের কথা শুনে শিশু শেখে এবং সারা জীবন মনে রাখে। মুখের ভাষা কখনোই প্রামাণিক ভাষা নয়। প্রামাণিক বা স্ট্যান্ডার্ড ভাষা চেষ্টা করে শিখতে হয়। যে বিদ্যালয়ে এ কাজটি ঠিকভাবে করানো হয়, সে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কর্মজীবনে অনেক সুবিধা পায়। একটি বিদ্যালয় ভালো কি খারাপ নির্ভর করে তার ভাষা শেখানোর ওপর। বিস্ময়ের ব্যাপার, বাংলাদেশে ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়গুলো ইংরেজি ভাষা ছাত্রছাত্রীদের সঠিক উচ্চারণে শেখায় এবং তারা ইংরেজদের কাছাকাছি উচ্চারণে কথা বলতে শেখে। বাংলায় সে রকম দেখা যায় না। বাংলায় প্রমিত উচ্চারণে খুব কম লোকই কথা বলতে শেখে। টিভি চ্যানেলগুলো খুললে সেটা স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। প্রমিত উচ্চারণে বাংলা যমুনা পদ্মা মেঘনার বাম তীরে শেখানো হয় না। তবে টেলিভিশন এ কাজটি করায় কথ্য বাংলার উন্নয়ন হচ্ছে।

বাংলা খুব উন্নত ভাষা। হাজার বছর আগে এর উন্নত রূপ প্রকাশ পায়। (‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’- আবদুল হাকিম)। ইংরেজ রাজত্বের শুরুর দিকে সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে পড়ে এর রূপ বিকৃত হতে শুরু করলে বঙ্কিমচন্দ্র, যার ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল এবং ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা (বিদ্যাসাগর) ইংরেজি সাহিত্যের অনুসরণে লিখে বাংলা কেমন হওয়া উচিত যিনি দেখিয়ে দেন এবং মাইকেল মধুসূদন যিনি ইংরেজি শিখে বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দে মহাকাব্য ও কবিতা রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, তাদের পরে রবীন্দ্রনাথ এসে বাংলা ভাষাকে করেন বিশ্বমানে উন্নীত। করে সাহিত্যে পান নোবেল (১৯১৩)। এর পরে আসেন চির উন্নত শির কাজী নজরুল যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে। তিনি ভাঙা কেল্লায় উড়িয়ে দেন বিজয় নিশান। হঠাৎ নজরুল বাকহারা হয়ে গেলে আসেন সর্বহারার কবি সুকান্ত। তিনি হিমালয় থেকে সুন্দরবন পুরো জনপদকে শোনান সর্বহারার উত্থানের জয়ধ্বনি। এদের পথ বেয়ে জনতা এগিয়ে চলায় সৃষ্টি হয় একুশে ফেব্রুয়ারি ও ছাব্বিশে মার্চ। এক কথায় হাজার বছর সাধনার বাঙালির বাংলাদেশ, যার রূপকার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এ সম্মোহনী কথাই ইতিহাসে প্রথম বাঙালির রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। সবটাই তো কথার অবদান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads