• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

জীবন-জীবিকার বাজেটে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

  • প্রকাশিত ১০ জুন ২০২১

আ ব দু ল  হা ই  র ঞ্জুধ

 

 

 

বৈশ্বিক মহামারী করোনার ছোবলে আজ স্তম্ভিত গোটাবিশ্ব। বিপর্যস্ত অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, শিল্পকারখানা সবই যেন স্থবির। সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে সমানতালে। আমাদের দেশে তো করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে হঠাৎ করে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় সংক্রমণের হার বেশি। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই সংক্রমণ ভারতীয় ধরনের। ভয়াবহ এই পরিস্থিতির মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ৩ জুন জাতীয় সংসদ ভবন থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট উপস্থাপন করেন। স্বাধীনতা-উত্তর গত ৫০ বছরের মধ্যে এবারের বাজেটের অঙ্ক যেমন সবচেয়ে বেশি, তেমনি বাজেটে ঘাটতিও বেশি। এর পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ টাকা। এ ঘাটতি দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে পূরণ করা হবে।

আর এ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ করোনা মহামারীর কারণে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। করোনার কারণে লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা বন্ধ থাকায় কাজ হারাতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। ফলে কর্মহীন হয়ে বেকারত্বের কারণে বিপুল এক জনগোষ্ঠীর আয়-রোজগার বলতে তেমন কিছুই ছিল না এবং এখনো নেই। ফলে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে কোটি কোটি মানুষকে। এখনো ব্যবসা-বাণিজ্য, মিল-কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। বরং করোনার কারণে সৃষ্ট নতুন করে দারিদ্র্য বেড়েছে, তারা এখনো অর্থনৈতিক সংকটের মুখেই হাবুডুবু খাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক গতি হারিয়ে বাঁক নিয়েছে ভিন্ন পথে। এখন তাই উন্নয়ন ভাবনা নয়, সরকারের পক্ষে দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিপথে ফিরিয়ে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারের মূল লক্ষ্য অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। তাই এবারের বাজেটকে অর্থমন্ত্রী অবহিত করেছেন জীবন-জীবিকার বাজেট হিসেবে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও মানুষের জীবন রক্ষায় স্বাস্থ্য খাতকে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে ৩২ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, যদিও এ খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে এবারের বাজেটে ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার বাড়তি বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আবার ভ্যাকসিন কেনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করাও আছে। সব মিলে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে যৌক্তিক বলেই আমরা মনে করি। তবে স্বাস্থ্য খাতে শুধু বাড়তি বরাদ্দ দিলেই হবে না, বরাদ্দের এ অর্থের যেন সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ করোনার এই মহাদুর্যোগের সময়ও স্বাস্থ্য খাতের নানা দুর্নীতি, অনিয়মের কথা শুনতে হয়েছে দেশবাসীকে, যা সত্যিই বেদনাদায়ক। কথায় আছে-‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। আর সেই খাতে যদি দুর্নীতি, লুটপাট করে জনগণের টাকা জলে চলে যায়, তাহলে এটা বড় কষ্টের ব্যাপার। আর আমাদের দেশে যে শুধু স্বাস্থ্য খাতেই দুর্নীতি, লুটপাট হচ্ছে তা নয়, কম-বেশি প্রতিটি খাতেই দুর্নীতি, লুটপাট, অনিয়ম লেগেই আছে, যা বিভিন্ন সূত্রে জনগণ জানতে পারে। আর তাই এবারের জীবন-জীবিকার বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অর্থের যেন সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হয় সে বিষয়টি সরকার দেখবে বলে প্রত্যাশা।

উল্লেখ্য, মহামারী করোনার কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতির কথা আগেও বলেছি। ঘুরেফিরে এই সংকটের কথাই বার বার আসে। কারণ সবকিছুর মূলেই অর্থ। অর্থ ছাড়া কোনো কিছুই করা সম্ভব হয় না। এ কারণে বাজেট আসলেই অর্থমন্ত্রীর মাথার ব্যথা বেড়ে যায়, কোন খাত থেকে বেশি করে রাজস্ব আদায় করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়। অবশ্য বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর সমৃদ্ধির প্রতীক হচ্ছে কর্মসংস্থান। এ কারণে এবারের বাজেটে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন, এই বাজেট ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। তিনি বলেন, নতুন অর্থবছরের জন্য ‘জীবন ও জীবিকা’র প্রাধান্য দিয়ে আগামীর বাংলাদেশের জন্য দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করা হলো। আবার এটাও ঠিক, দেশের বাজেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘাটতি বাজেটও এটা। সবদিক বিবেচনায় নিলে বলা যায়, বাজেট যতই বড় হবে, ততই মঙ্গল। কারণ অর্থছাড়া তো কোনো কাজই করা সম্ভব না। আর দেশের অবকাঠামোগত খাতের উন্নয়নে যেভাবে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ছে, তাতে জনগণের ওপর নানাভাবে করের বোঝা ও ঋণের বোঝাও চাপানো হচ্ছে। আর প্রতি বছরই সরকার বাজেটে করের আওতা বৃদ্ধি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে রেকর্ড করেছে জমি-জমা নিবন্ধনের ফি। কারণ জমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সরকার যে হারে ফি আদায় করছে, তা মনে হয় পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। আর এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অযৌক্তিকও বটে। কারণ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে এই কর আরোপ করা হলে শিক্ষা ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। ফলে শিক্ষার হার সংকুচিত হয়ে যাবে।

মানুষের মৌলিক অধিকার শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বাসস্থানের মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। কারণ শিক্ষিত জাতি ব্যতীত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। স্বপ্ন ছিল, দেশ স্বাধীন হবে, শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও সর্বজনীন। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, স্বাধীনতা অর্জন করেছি ৫০ বছর হলো। শিক্ষা অবৈতনিক ও সর্বজনীন তো হয়নি, উল্টো শিক্ষা অর্জনে ব্যয় বেড়েছে, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত না হওয়ায় মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের তাগিদেই নানা কৌশলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে, যদিও সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন এখন সরকার শতভাগই প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে অনন্য এক দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন, এটাও সত্য। তারপরও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে স্থাপিত না হওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদে দেশে প্রায় সরকার অনুমোদিত ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়েছে। এখানে পড়াশোনা করে মূলত দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ছেলেমেয়েরা। সূত্রমতে, গত ২০১৪ সালেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ছিল ২ লাখ টাকা, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকায়। অর্থাৎ মাত্র ৭-৮ বছরের মধ্যে শিক্ষা খরচ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এ চাপ সামাল দিতে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আজ চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা! আবার ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের’ মতো ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি শিক্ষায় কোন যুক্তিতে অর্থমন্ত্রী ১৫ শতাংশ করের প্রস্তাব করেছেন, তা বোধগম্য নয়।

যখন এ বাজেটকে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিবিসিআই ব্যবসাবান্ধব বাজেট হিসেবে বিবৃতি দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন, তখন বাজেটে বেশিরভাগ জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্তের ওপর বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বাজেট প্রসঙ্গে বলেছে, করোনায় আর্থিক চাপে থাকা মধ্যবিত্ত ও ৬ কোটি দারিদ্র্য মানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই। সংস্থাটি মনে করে, এ বাজেট ধনীদের আরো ধনী করবে। কারণ করোনার কারণে মধ্যবিত্তদের হাতে টাকাপয়সা নেই। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অবস্থাও তথৈবচ। বেসরকারি শিক্ষার ওপর বাড়তি করের বোঝা এসব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সংকটে ফেলবে। ফলে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বৃহত্তর স্বার্থে প্রস্তাবিত এই কর যেন কোনোভাবেই আরোপ করা না হয়, তা নিশ্চিতের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তীক্ষ দৃষ্টি অতি আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ড. মো. সেলিম উদ্দিন ২০২১-২২-এর প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে বলেন, বিশ্বব্যাপী মহামারী কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বিগত বছর থেকে আমাদের জীবন তথা স্বাস্থ্য এবং জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক অস্বাভাবিক, অসাধারণ, অস্থির, অনিশ্চিত, বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনো চলমান। বিদ্যমান এই পরিস্থিতিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটটি জীবনকে সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করবে মর্মে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, অনেকেই মনে করেন বড় আকারের বাজেটে অর্থের অপচয় ও অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে তিনি মনে করেন, এই বাজেটের অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে যথাযথভাবে ব্যয়ে অপব্যবহার রোধ ও অপচয় রোধে সচেতনতাসহ কঠোরতা অবলম্বন করলে মহামারী কোভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাবে পতিত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা অনেকাংশেই সম্ভব হবে। আমরাও মনে করি, ২০২১-২২ অর্থবছরের ঘোষিত বিশাল অঙ্কের বাজেটের অর্থের যেন যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। তা না হলে ধারদেনা করে জোগান দেওয়া অর্থ জনগণের সহায়ক না হয়ে বরং সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজ বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads