• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন নিয়ে বিতর্ক অনাকাঙ্ক্ষিত, অমর্যাদাকর

ফাইল ছবি

সম্পাদকীয়

মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন নিয়ে বিতর্ক অনাকাঙ্ক্ষিত, অমর্যাদাকর

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৬ জুন ২০২১

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন করার সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, যখন তিনি প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসেন ১৯৯৬ সালে। এটি ছিল শেখ হাসিনার শাসনামলের অত্যুজ্জ্বল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। এত বছর পরে হঠাৎ একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয় এই মহান সিদ্ধান্তটিকে ঘিরে। অহেতুক বিতর্কটি সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। ওই সিদ্ধান্তে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন অনুষ্ঠানে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)-দের উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে। যে অজুহাত তুলে সংসদীয় কমিটি এই বিতর্কিত সুপারিশটি করেছেন তা অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সংবিধানবিরোধী এবং মহান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবমাননাকরও বটে। মহান জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে সারা দেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যে মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তথা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, সে সময় এমন একটি ঘটনা ঘটা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় ছিল না।

মর্মন্তুদ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শুরু হয়েছিল একদিকে ইতিহাস বিকৃতির পালা, অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা। আত্মপ্রতারণার গিলাফ দিয়ে গোটা জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ছলচাতুরীর কফিন দিয়ে দাফন করা হয়েছিল আমাদের সবকিছু—আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অহংকারকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং চেতনাকেও। জাতির পিতাসহ মুক্তিযুদ্ধের মহান সিপাহসালারদের চরিত্র হনন করে ইতিহাস থেকে বিদায় করার আয়োজন করা হয়েছিল। অপরদিকে কিছু খলনায়ককে এনে জাতির ইতিহাসে অভিষিক্ত করার প্রয়াস চালানো হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর জাতীয় জীবনে কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে, যখন জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সমর্থনে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের অধিকারী হন।

ক্ষমতা গ্রহণের কদিন পরেই মুক্তিযুদ্ধ সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নেতা অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করেন। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ওই সময় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস টিমে কর্মরত ছিলাম। সিদ্ধান্তটি যখন ঘোষণা করা হয়, সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম এবং যথারীতি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে বাসসে সংবাদটি পরিবেশন করি। সিদ্ধান্তটি ভালো লাগলে এর অন্তর্নিহিত গভীর মর্ম উপলব্ধি করতে আমাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট। আমাদের বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালি থানাধীন কাশিপুরে। হঠাৎ গভীর রাতে খবর এলো, আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই মফিজুল ইসলাম ভূঁইয়া (যিনি সুরু ভূঁইয়া নামে পরিচিত) হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। চোখের জলে, মুখের জলে একাকার হয়ে আমি প্রাইভেট কার নিয়ে ঢাকা থেকে কাশিপুরে পৌঁছলাম। পথেই দেখলাম আমাদের বাড়ির মাইলখানেক দূরে চৌহুতপুর মাদরাসা প্রাঙ্গণে ভাইয়ের নামাজে জানাজার আয়োজন চলছে। যথারীতি বরিশাল জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি শোকবার্তা বহন করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয় সেখানে উপস্থিত হলেন। কিন্তু গার্ড অব অনার প্রদান করার জন্য পুলিশ কন্টিনজেন তখনো পৌঁছেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই বিক্ষুব্ধ হলেন এবং সূর্যাস্তের আগেই দাফন করতে হবে বলে সকলে জানাজা অনুষ্ঠানের তাগিদ দিতে লাগলেন। অগত্যা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মহোদয় ডিসি সাহেবের সই করা শোকবার্তাটি পড়ে শোনালেন, যেখানে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার অকুতোভয় নানাভাইয়ের (আমার মেজোভাইকে আমরা নানা বলে ডাকতাম) গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা তুলে ধরে জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানানো হলো।

জানাজা শেষে আমরা চৌহুতপুর থেকে আমাদের কাশিপুরে পারিবারিক গোরস্তানের দিকে লাশ নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। একপর্যায়ে তার জন্য প্রস্তুত করা কবরের পাশে লাশ নামানো হলো। হঠাৎ দূর থেকে দেখলাম হুইসল বাজাতে বাজাতে একদল পুলিশ এসে উপস্থিত হলেন। বিলম্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন এবং গাড়ি জোগাড়ে সময় লেগেছিল বলেই তাদের একটু দেরি হয়েছে বলে আমাদের জানালেন। শুরু করলেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের পালা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় সুরু ভাইকে যখন কবরে হিমশীতল কোলে সমাধিস্থ করতে যাচ্ছিল, সেই শোকাবহ পরিবেশ হঠাৎ বিউগলের করুণ সুর মূর্ছনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠল। পড়ন্ত সূর্যের শেষ রশ্মি সদ্য খোঁড়া কবরের চারপাশের বাঁশবনে এসে আছারি-পাছারি খাচ্ছিল। সেই মুহূর্তে পুলিশের বিউগলের ‘রিকোইমের’ (মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে বাজানো করুণ সংগীত) মূর্ছনায় পল্লিপ্রান্তর এক স্বর্গীয় সুধায় সিক্ত হয়ে উঠল। সকল শোকাহত আত্মীয়স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও উপস্থিত ব্যথাতুর মানুষের মনে পুলিশের সশস্ত্র অভিবাদনের ছন্দায়িত শব্দ এক চমৎকার সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে দিল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো মৃত্যু সত্যিই কখনো কখনো সুন্দর ও মায়াবী হতে পারে। মৃত্যু কখনো কখনো সার্থক ও মধুময় হতে পারে। আগেই উল্লেখ করেছি-এই সিদ্ধান্তটি যখন হয়, আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম এবং যথারীতি সংবাদটি বাসসে পরিবেশন করেছি। কিন্তু এর গভীরতা তখন উপলব্ধি করতে পারিনি। নিজ ভাইয়ের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হওয়ার পর আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটা কোনো সাদামাটা সিদ্ধান্ত ছিল না। এ ছিল একটি অনন্য সিদ্ধান্ত, ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।

আমি আমার গ্রন্থ ‘শেখ হাসিনার শাসনামলের অনুগল্পে’ এই সিদ্ধান্তটির কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলাম, ‘রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধাদের দাফন করার ঘোষণাটি শেখ হাসিনার শাসনামলে সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত।’

এর পরে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে। হঠাৎ করে এসেছে করোনার মহাদুর্যোগ। এ কোন গজব, এ কোন ভয়াবহ বিপর্যয় বুঝতে না বুঝতেই আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিতে শুরু করলেন ত্যাগী রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন মন্ত্রী, এমপি, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীসহ অনেক সাধারণ মানুষও। হঠাৎ সরকারও বিব্রত হয়ে গেলেন করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের দাফন প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন করা হবে তা নিয়ে। আমি ২০২০ সালের এপ্রিলের শুরুতেই বাংলাদেশের খবরের কোনো এক সংখ্যায় লিখেছিলাম, ‘করোনায় মারা গেলেও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন’। আমি বলেছিলাম, ‘আল্লাহ না করুক আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যদি এই অজানা-অচেনা ঘাতক করোনায় মারা যাই, তবু যেন কোনো প্রকার ওজর-আপত্তি দাঁড় করিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত না হয়।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলাম, ‘আপনার চার দফা শাসনামলে সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত হলো মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দাফন। এ সিদ্ধান্ত যে কোনো পরিস্থিতিতেই সমুন্নত রাখতে হবে।’

আজ যখন আবার শুনতে হয় কিছু ওজর-আপত্তি তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদাকে বিতর্কিত ও ম্লান করার চক্রান্ত হচ্ছে, তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লালিত্য আদর্শের সৈনিকদের হূদয়ে রক্তক্ষরণ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারলাম, নারীরা নাকি জানাজায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। এজন্যই নারী ইউএনওদের পরিবর্তে পুরুষ কর্মকর্তাদের দিয়ে এ দায়িত্বটি পালন করার জন্য এই সুপারিশ করা হয়েছে। আসলে এটি একটি ছুতা মাত্র, ছলচাতুরী মাত্র। জানাজা এক কথা আর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পালন করা ভিন্ন কথা। আমি একাধিকবার স্বচক্ষে দেখেছি পার্লামেন্টের সাউথ প্লাজায় যখন রাজনীতিক ব্যক্তিত্ব, সংসদ সদস্য প্রমুখের জানাজা হয়, তখন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় স্পিকার সেখানে আসেন, একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকেন নীরবে এবং জানাজা শেষে মরহুমের কফিনে তাদের পক্ষ থেকে পুষ্পমাল্য প্রদান করা হয়। এখানে পার্লামেন্টের সংসদ বিষয়ক কমিটি মহিলা বলে ইউএনওদের উপস্থিত না করে বিকল্প কর্মকর্তাদের দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দফানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের যে কথাটি বলেছে, তা একেবারেই অসার ও অগ্রহণীয় যুক্তি, যা আমাদের নারী-পুরুষের মধ্যে একটি বৈষম্য সৃষ্টি করবে। নারী হিসেবে তিনি জানাজাস্থলে উপস্থিত হয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শোকবার্তাটি পাঠ করলে এমন কী ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘন হবে? এমনকি কফিনে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ফুল দিলেও কী ব্যত্যয় ঘটবে? জানাজায় মেয়েদের অংশগ্রহণ না করা বিধানের সাথে এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। রাষ্ট্রীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। এতে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য টানার কোনো অবকাশ নেই। সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে নারীদেরও অপমান করা হবে আবার একই সাথে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরও অসম্মান করা হবে। আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার থাকা সত্ত্বেও সংসদীয় কমিটি কেন এই বৈষম্যমূলক বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে, বিষয়টি বোধগম্য নয়।

সুখের কথা, বিষয়টি এখনো সুপারিশ আকারে রয়েছে। ইতোমধ্যে সংসদে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব সংগঠনের পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সংগঠনগুলোও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্থাভাজন মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের ওপর সবার আস্থা ও ভরসা রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বিবেচনা করার আগে তারা সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তির অনুভূতিকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখবেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads