• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সংকট : প্রাচ্যের ফিলিস্তিন হবে কি

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১৭ জুন ২০২১

মো. সজল হোসেন

 

মিয়ানমার সরকার ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিধনে যে অপারেশন পরিচালনা করে তাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা এবং ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। জীবন বাঁচাতে নিরীহ রোহিঙ্গারা তাদের মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয় এবং শরণার্থী হিসেবে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরকার তখন সর্বোচ্চ উদারতার পরিচয় দেয়। যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তখন স্থানী  উখিয়া-টেকনাফের মানুষ তাদের সবকিছু উজাড় করে সাহায্য করেছিল। এমনকি সমগ্র বাংলাদেশের মানুষই তাদের আপন করে নিয়েছিল, নিজেদের আবাসস্থলে রোহিঙ্গাদের থাকতেও দিয়েছিলেন। এর অন্যতম কারণ ছিল ধর্মীয় সহানুভূতি এবং মানবিকতাবোধ। কিন্তু এখন সেটিতে ভাটা পড়েছে।

আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে আলোচনা হলেও মিয়ানমারের ওপর কোনো প্রকার চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারেরও কোনো সদিচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। এখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আদৌ ফিরে যাবে কি-না, সেটি নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ। এদিকে করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিরও টালমাটাল অবস্থা। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) তাদের ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের এক গবেষণায় বলছে, ‘বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে’। ২০১৮ সালে ছিল ২১ শতাংশ। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে? এছাড়া এটি বিপুল জনসংখ্যার একটি দেশ, বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে নবম। এই বিপুল জনসংখ্যার চাপের ওপর আরো অতিরিক্ত ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। এসব শরণার্থীর প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রথমে অনেক অনুদান এলেও এখন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আর ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সরকারকে এ দেশের জনগণের করের টাকা থেকে একটা বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। জাতিসংঘ সনদে সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর দমন নিপীড়ন বা বৈষম্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী তা মানছে না। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক চাপ এবং বিশ্ব দরবারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তা না হলে প্রাচ্যের ‘ফিলিস্তিন সংকটে’র মতো রোহিঙ্গা সমস্যা আরেকটি সংকট হয়ে উঠতে পারে। এরই মধ্যে দেশীয় দালালদের সহায়তায় ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছে রোহিঙ্গারা। মাত্র ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) পাচ্ছে রোহিঙ্গারা (১৯ জানুয়ারি, প্রথম আলো)। এভাবে এনআইডি নিয়ে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। কোনো সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দেবে, ক্যাম্প থেকে গোপনে বেরিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। জমিজমাও কিনতে পারবে অর্থাৎ দেশের নাগরিক হিসেবে সবগুলো অধিকার ভোগ করতে পারবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি ক্ষোভ থাকবে মনে মনে, ‘আমরা তো এদেশের নাগরিক না আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ড দরকার’।

গত ৩১ মে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার, ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিরা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের দেখতে যান। তারা সেখানে পৌঁছানোর পরই ৫০০ থেকে ৬০০ জন রোহিঙ্গা বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের দাবি, মাসে হাতখরচ বাবদ পাঁচ হাজার টাকা, মানসম্পন্ন রেশন এবং চিকিৎসা সুবিধা তাদের দিতে হবে। আজ কয়েকশ রোহিঙ্গা বিক্ষোভ করেছে, কাল হাজারও রোহিঙ্গা বিক্ষোভ করতে পারে। এভাবেই একদিন বলবে আমরা নিজেদের জন্য ভিটেমাটি চাই, এভাবে আমরা একটা গণ্ডির মধ্যে থাকতে চাই না। আমাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার চাই। এই বিদ্রোহ ধীরে ধীরে ছোট থেকে বড় আকার ধারণ করতে সময় লাগবে না।

সম্প্রতি গত ২১ জানুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফের চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অস্ত্রসহ পাঁচ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে আটক করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা। র্যাব ও বিজিবির দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজারের সীমান্ত ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে চলতি বছরের বিগত ৯ মাসে প্রায় শতাধিক দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে। এ সময় আরো ২১১টি গোলাবারুদ পাওয়া গেছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্রসহ অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা ডাকাতকে আটক করা হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। এছাড়া আগের বছর এসব ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ২৬টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ১৩৮টি গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিল র্যাব। এসব ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করছে, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

বর্তমানে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার কোনো সম্ভাবনা নেই। মিয়ানমার বরাবরই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করে এসেছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরা বাঙালি, তাদেরকে উপনিবেশ শাসনের সময়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এ দাবির ভিত্তিতে তারা প্রতিনিয়ত এমন হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রাখলে দশ-বিশ বছর পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা কোটি পার হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে বিদ্রোহী সংঘটন তৈরিরও আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। বিশেষ করে যখন কঠোর নিরাপত্তার মাঝেও তাদের থেকে বিপুল দেশি-বিদেশি অস্ত্র পাওয়া গেছে। আর এভাবেই এটি প্রাচ্যের ফিলিস্তিন সংকটে পরিণত হতে পারে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্যে আবারো কক্সবাজারের বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৬ হাজার একর বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ রোহিঙ্গাদের সাথে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের  ভাষাগত মিল আছে। ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে বিদ্রোহী অথবা জঙ্গি সংগঠনও তৈরি হতে পারে। ইউএনএইচসিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত ২২ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে ১৫ জন নিহত ও ৫৬০ জন আহত হয়েছে; নিখোঁজ রয়েছে ৪০০ জন। ভাষাগত মিলের কারণে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পার্বত্য অঞ্চল আগে থেকেই উত্তপ্ত। পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছর পার হলেও তিন পার্বত্য জেলায় সংঘাত, অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। এই চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক এখনো থামছে না। চুক্তি স্বাক্ষরকারী পাহাড়ি আদিবাসী সংগঠন জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিভিন্ন গোষ্ঠী নানান উদ্দেশ্য নিয়ে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাচ্ছে এবং সেখানে অস্থিরতা বাড়ছে। মাঝেমধ্যে আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানতে পারি, আদিবাসী সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা করেছে এবং নিরাপত্তাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছে। এর সঙেঙ্গ যদি আবার রোহিঙ্গা সংকট ঘনীভূত হয়, তবে পরবর্তীতে আমরা চট্টগ্রাম বিভাগের একটি অংশ হারিয়েও ফেলতে পারি।

সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান এখনই করতে হবে। নতুবা ভবিষ্যতে এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়বে। তারা ভিনদেশী, তাই নাগরিকত্বও দেওয়া সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করবে। আর পার্বত্য অঞ্চলে উপজাতি সমস্যাও এখনো রয়েছে। ফলে উপজাতি কর্তৃক রোহিঙ্গাদের সাহায্য এবং একত্রিত হয়ে বিদ্রোহের সম্ভাবনা থাকবে। এক্ষেত্রে তারা গোপনে অন্য দেশের সাহায্যও লাভ করতে পারে। তাদের বিচরণস্থল হতে পারে পাহাড়ি অঞ্চল। এভাবেই দেশে গৃহযুদ্ধ সৃষ্টির একটি সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে। রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার এবং ভাসানচরে অনির্দিষ্ট কালের অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠার আগেই এর সমাধান দরকার। তাই বর্তমান সরকারের উচিত, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্যে আন্তর্জাতিক মহলে এবং জাতিসংঘের ওপর কূটনৈতিক চাপ জোরদার করা। অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করা। অন্যথায় রোহিঙ্গা ইস্যু হয়ে উঠতে পারে ‘প্রাচ্যের ফিলিস্তিন’ সংকটের মতো ভয়াবহ।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads