• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

করোনা এবং আগামী দিনের শিশুশিক্ষা

  • প্রকাশিত ১৮ জুন ২০২১

এম এ হান্নান মিঞা                   

 

গত বছরের ফেব্রয়ারির মধ্যভাগে দেশে করোনার রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাওয়ার পর ২/৪ দিন বিদ্যালয় খোলা থাকলেও তারপর মধ্য মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুলসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু মাঝে  করোনার সংক্রমণ কমে গিয়ে আবারো নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ ২০২০-এর মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সরকার রেডিও, টিভি ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে তা ভেবে দেখা দরকার। সম্প্রতি দেশে কিছু বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এসব সুবিধা পাচ্ছে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থায় রয়েছে। একইভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ৬৭ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রের এই চিত্র ভবিষ্যতে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে বলেই মনে হচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে গত প্রায় ১৫ মাস ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি থাকায় প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে। কওমি মাদরাসা ও কিছু কোচিং প্রতিষ্ঠান ছাড়া এ সময় প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবে কয়েকদিন আগে মাদরাসাগুলোকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষার্থীরা বিশেষকরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা যেমন প্রতিদিনকার শিক্ষা অভ্যাস থেকে বাইরে আছে এবং একইসঙ্গে তার অর্জিত দক্ষতাগুলো ক্রমেই ভুলতে বসেছে। গত বছরের বেসরকারি এক গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের  প্রায়  ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেও বাংলায় সাধারণ একটি বাক্য ভালোভাবে পড়তে ও বুঝতে পারে না। ২০২১ সালের সংশ্লিষ্ট এক গবেষণায়  প্রকাশিত যে, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এই হার  প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যস্ত বেড়ে যেতে পারে। এই গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ইন্টারনেট  কার্যক্রম শুরু করলেও তা ততটা কার্যকর নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করার উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি এখনো। ফলে এসব শিক্ষার্থী ঠিকমতো শিক্ষায় মনোযোগী হতে পারে না।

করোনায় ভিন্ন ভিন্ন আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর শিশুদের ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব পড়েছে। শুধু শিক্ষার অভ্যাস থেকে দূরে থাকা নয়, এদের মধ্যে অনেকেই শিশুশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কারণ দারিদ্র্যের পাশাপাশি করোনায় কর্মহীনতা তাদের এ পতে আসতে বাধ্য করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় অর্ধকোটি শিশু ও কিশোর-কিশোরী যাদের বয়স ৬ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, যারা স্কুলের বাইরে আছে, এদের ৭০ শতাংশই গ্রামে বসবাস করে। আবার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে যারা শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তাদের অনেকেরই শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। ২০১৯ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার প্রায় ২০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্য বাড়ার কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে গেছে, যা হয়তো ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। একই বছরে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, দরিদ্রতা বাড়ার সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। দরিদ্রতা লাঘবের জন্যে  কিশোররা শ্রমের দিকে ঝুঁকছে। তাদের অনেকেই পেটের দায়ে স্কুল ছুটির কারণে শ্রম বিক্রি করছে।

করোনার কারণে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা স্কুলে না যেতে পেরে এদের অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। করোনায় শহরের শিশু-কিশোররা চার দেয়ালের মাঝে বন্দি থাকলেও গ্রামের কোনো শিশু-কিশোররা ঘড়ে বসে থাকে না। এরা সাধারণত হাটবাজার, পাড়া-মহল্লা, খাল-বিল-নদী বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে এই সময়ে গ্রামের শিশুদের তুলনায় শহরের শিশুরা শিক্ষা গ্রহণে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত। ফলে এই শিশুরা বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় এবং সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পার্থক্য শুধু শহুরে শিশুরা অনেক বেশি অনলাইন শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে, বিশেষত ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিভাইসের বিবেচনায়। আর ইন্টারনেট খরচ ও প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকার কারণে গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীরা অনলাইন স্কুল থেকে অনেকখানি দূরে। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুর শিক্ষার পাশাপাশি, তার সামাজিক দক্ষতা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে। কীভাবে স্কুলে শিক্ষা গ্রহণের ঘাটতি মোকাবিলা করা যায় তা বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারের যেমন ভূমিকা আছে একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংবাদপত্র সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে এই উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে যদি প্রত্যেকটি শিশুকে যোগাযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা না যায় এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতা প্রদান করা না যায়, তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এ অবস্থায় শুধু দূরশিক্ষণ ও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমই যথেষ্ট নয়। গ্রাম অঞ্চল ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তো নয়ই। কারণ তারা অর্থনৈতিক সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে আবর্তিত হয়ে থাকে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করতে হয়। কোনো শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষকদের সাধারণত নিয়মিত স্কুলে যেতে অনীহা থাকে। উপরন্তু করোনার কারণে স্কুল ছুটি থাকায় তারা আরো যাবে না, এটাই স্বাভাবিক।

১৭ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ বার ছুটি বাড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। করাটাও জরুরি ছিল। কেননা  হাট-বাজার, শপিংমল, রাস্তা-ঘাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য জনগণ চলাফেরা করছে, কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে স্কুলের শিক্ষকরা অতিরিক্ত বেতন নিয়ে করোনাকে পুঁজি করে ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে ছোট্ট রুমে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী নিয়ে কোচিং করাচ্ছে, অথচ সেখানে কোনো স্বাস্থ্যবিধি, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছেন না। এ অবস্থায় যদি স্কুলের বড় ক্লাসরুমে নিয়ম মেনে অল্প পরিসরে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যেত, এতে প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা হয়তো কিছুটা হলেও পাঠ্যকার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারতো।

করোনাকালীন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুবই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। আমরা জানি জীবন সবার আগে। তাই এই সতর্কতা। বিশ্বের অনেক ধনী, সচেতন, অভিজ্ঞ দেশ আছে তারা এখনো করোনাকে বাগে আনতে পারছে না। আবার ছোট দেশ হয়েও করোনার মহামারি থেকে দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে। আমাদের দেশ এখনো মহামারীতে পরিণত হয়নি। জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  দূরদর্শিতার জন্যে। যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেক বড় আশঙ্কা থেকে দেশ-জাতি রক্ষা পেয়েছে। সরকার এই দুঃসময়ে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে যে অনলাইনের শিখনের ব্যবস্থা করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও এই অনলাইন ব্যবস্থা আমাদের কাছে নতুন, অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা তেমন একটা উপযোগী নন। তারপরও অনেকেই কিছুটা হলেও শিখতে পারছে।

 

কিন্তু সমস্যটা অন্যত্র। ঘরে বন্দি থেকে শিক্ষার্থীরা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্যগত ভাবে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অফিস-আদালত, দোকান-হাট, রেস্টুরেন্ট চলছে নিয়মিত। জনতার ভিড়ে চলাফেরা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। সবকিছুই চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতো। পরিস্থিতি এমন যে সবই চলছে ঠিকঠাক, শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। এখন অনেক শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কবে স্কুলে যেতে পারবো? প্রশ্নটির সঠিক উত্তর দেওয়া দুষ্কর।

প্রান্তিক পর্যায়ে স্কুল ও শিক্ষকদের শিক্ষার্থীর পরিবার ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করতে হবে। করোনা শেষে স্কুল খোলার অপেক্ষা না করে প্রয়োজনীয় রুটিনমাফিক উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য শিক্ষা বিভাগ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারে। আবার করোনা শেষে যখন স্কুল খোলা হবে কীভাবে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়, তারও পরিকল্পনা এখন থেকেই করতে হবে। সেজন্য শিক্ষকদেরও প্রস্তুত করে তুলতে হবে। অন্যদিকে এই সময়ে শিশুরা যাতে শিক্ষা থেকে ঝরে না পরে, সেজন্য দরিদ্র পরিবার ও তাদের শিশুদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বর্তমান অবস্থায় শুধু করোনা থেকে বেঁচে থাকা নয়, শিশুর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি ফেরাতে হবে। আজ ও আগামী দিনের জন্যে এই কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেই লক্ষ্যে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করার এখনই সময়।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads