• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

শাটডাউন, স্বাস্থ্যবিধি ও নতুন জীবনের আলো

  • প্রকাশিত ২৮ জুন ২০২১

আর কে চৌধুরী

 

হঠাৎ করেই বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ যেন বৃদ্ধি পেল। বলা হতো শীতপ্রধান অঞ্চলেই করোনার থাবা প্রবল, যেটি আমরা গত ২০১৯-এর ডিসেম্বরে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ পর্যবেক্ষণে বুঝেছিলাম। কিন্তু বিশেষজ্ঞ সব গবেষণাকে পর্যুদস্ত করে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশে করোনা তার বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল; ঠিক তেমনিভাবে এ বছরেরও এই সময়টিতে এসে করোনা তার রুক্ষ চেহারা প্রদর্শন করছে আমাদের পরিবেশ ও মানবকুলে। সঙ্গে যোগ হয়েছে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইত্যাদি। আর তাইতে আজ থেকে সরকার বাধ্য হয়েছে কঠোর লকডাউন বা শাটডাউন দিতে। 

এর আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানীর সঙ্গে পাশের সাত জেলার যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। লকডাউন পালনের অংশ হিসেবে রাজধানীর প্রবেশমুখে আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি। লকডাউনে যাত্রীবাহী কোনো দূরপাল্লার যানবাহন রাজধানীতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য জেলার ট্রেন ও লঞ্চ যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে গত ২২ জুন ভোর ৬টা থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সাত জেলায় লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এ নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকা-আরিচা ও টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়ক দিয়ে ঢাকার আমিনবাজারে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি গণপরিবহন। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। কর্দমাক্ত পথে হেঁটে, বৃষ্টিতে ভিজে, চরম দুর্ভোগ সঙ্গী করে দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে রাজধানীতে পৌঁছে হাজারো মানুষ। এর বেশির ভাগই কর্মস্থলযাত্রী।

কঠোর লকডাউন ঘোষণা অপ্রত্যাশিত হলেও এর পেছনে সাধারণ মানুষের আইন না মানার প্রবণতা এবং মহামারীকে অবজ্ঞা করার মনোভাবই কার্যত দায়ী। গত ঈদে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মানুষ যেভাবে ঘরমুখো হয়েছে তা কোনো সভ্যসমাজে মহামারীর সময় কল্পনা করাও কঠিন। জনসমক্ষে মাস্ক ব্যবহারে সরকারের কঠোর হওয়া উচিত। বিশেষত রাজধানীর রাস্তাঘাট, বাজার এবং উপাসনালয়গুলোয় স্বাস্থ্যবিধি ভাঙার অশুভ যে প্রতিযোগিতা চলছে তা চলতে দেওয়া উচিত নয়। সরকার এদিকে কঠোর হলে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না বলে আশা করা যায়।

উচ্চশিক্ষায় থাবা বসিয়েছে করোনা। দেশে উচ্চশিক্ষার করুণ অবস্থা অনেক দিন ধরেই। ২০১৬ সালে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ৬০০ থেকে ৮০০ নম্বরের মধ্যে। সেই শেষ। তারপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ৩৬টি, এমনকি পাকিস্তানেরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এক হাজারের তালিকায়। আমাদের এমন পীড়াদায়ক অধোগতির সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা মহামারি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। কবে শুরু হবে তা-ও অনিশ্চিত। এমন অবস্থায় ক্ষতি পোষাতে বিভিন্ন ধরনের ছুটি বাতিল, শিক্ষাবর্ষের সময় কমানোসহ ছয়টি পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। গাইডলাইনটি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় এরই মধ্যে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে, তা এই গাইডলাইনে পূরণ হবে কি?

ইউজিসির গাইডলাইনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান একাডেমিক ক্যালেন্ডারের সময় উল্লেখযোগ্য ও গ্রহণযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে হবে। সেমিস্টার, টার্ম বা বার্ষিক পদ্ধতির ক্ষেত্রে ব্যাবহারিক বিষয়সহ সব বিষয়ের ক্লাস, ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ, সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা প্রচলিত সময়ের চেয়ে কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন ছুটি, যেমন সামার, উইন্টার ও ফেস্টিভাল ভ্যাকেশন কমানো বা পরিহার করা যেতে পারে। প্রতিটি ক্লাসের (তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক) সময় বর্তমানের মতোই বলবৎ থাকবে অর্থাৎ লেকচারের সময় কমানো যাবে না। প্রয়োজনে লেকচারের সংখ্যা কমালেও পুরো সিলেবাসের পাঠদান সম্পন্ন করতে হবে। ইউজিসি বলেছে, এই গাইডলাইন অনুসরণ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ রিকভারি গাইডলাইন তৈরি করতে পারবে। সেই প্ল্যান একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে।

অর্থনৈতিকভাবে দেশ অনেক এগিয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় কয়েক গুণ বেড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রীতিমতো বিপ্লব সাধিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আসল জায়গাটি অর্থাৎ শিক্ষায় যদি আমরা ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে যাই, তাহলে এসব উন্নয়ন অর্থবহ হবে কি? বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কেন বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও থাকবে না? দেশের মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

করোনা মহামারী সারা বিশ্বেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে। তার মধ্যেও অনেক দেশ শিক্ষার ক্ষতি রোধে নানা ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তাদের ক্ষতি অনেক কম হয়েছে। আমরা তেমন পদক্ষেপ নিতে পারিনি বললেই চলে। অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষার আয়োজনও ছিল আংশিক। এই অবস্থা থেকে উচ্চশিক্ষাকে রক্ষা করতেই হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। ইউজিসির গাইডলাইন মেনে এবং অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষার ক্ষতি যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে হবে।

এদিকে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু দেশের কোথাও কোনোভাবেই বিধি-নিষেধ বা ‘লকডাউন’ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। জেলায় জেলায় চলমান লকডাউনের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই সাধারণ মানুষের মাঝে। লকডাউনের বিধি-নিষেধের মধ্যে শহর ও গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে মানুষ ভিড় করছে। শনাক্ত ও মৃত্যুর হার প্রায় এক মাস ধরে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেই তুলনামূলক বেশি ছিল। ঢাকায় অনেকটাই স্বস্তি ছিল শনাক্ত ও মৃত্যু কম থাকায়। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি তথ্য সবাইকে নতুন করে ভাবিয়েছে। আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, তারা মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকার ৬০ জন করোনা রোগীর নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ৬৮ শতাংশের মধ্যে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট পেয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের বিধি-নিষেধ মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারের শাটডাউনের পথে চলা। এখন কোনো অবস্থাতেই কথিত লকডাউনের পথে হাঁটলে চলবে না। তাহলে জীবন যেমন রক্ষা পাবে না, তেমনি শিক্ষা, স্বাস্ত্য, অর্থনীতি সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রয়োজনে সরকার যে কঠোরতা কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়নে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপ কামনা করি। জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। দরকার হলে তাকে জেল-জরিমানায় আটকাতে হবে। মনে রাখতে হবে, উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে করোনায় কাছে পরাজিত হলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে। দিন দিন কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। দুর্ভিক্ষ শেষ করে দেবে জীবন ও জীবিকা, যার আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সুতরাং আসুন, আমরা সরকারকে সহযোগিতা করি। সবাই যথাযথ বাবে স্বাস্থ্যবিধি মানি। ঘরে থাকি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি। স্বল্প সময়েই করোনার প্রকোপ তেকে রক্ষা যাবে গোটা দেশে ও তার মানুষ। উদাহরণ পাশের দেশ বারতের রাজধানী দিল্লিতেই রয়েছে। হাজার হাজার মৃত্যুর মুখে সবকিছু বন্ধ করে তারা দুই সপ্তাহ বসে ছিল। ফলাফল এখন মৃত্যু হার দৈনিক শ’য়ের মতো। অতএব সরকার ঘোষিত শাটডাউন আমার কঠোরতার সঙ্গে পালন করি, এটাই একমাত্র পথ করোনা জয় করে নতুন জীবনের আলো দেখার।

 

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads