• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার কারণ ও প্রতিকার

  • প্রকাশিত ২৯ জুন ২০২১

মো. জিল্লুর রহমান

 

জলাবদ্ধতার সমস্যা শুধু ঢাকাবাসীদের জন্য নয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে এটি চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বড় বড় মেট্রোপলিটন শহরেও ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দেয়। সম্প্রতি ঢাকার বাসিন্দারা আবারও মারাত্মকভাবে জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হয়েছে, অবিরাম বৃষ্টিপাতে রাজধানীর বিভিন্ন অংশ ও প্রধান সড়কগুলো ডুবে গেছে। মূলত রাজধানীর বৃষ্টির পানি ঢাকা ওয়াসার খাল এবং নর্দমার লাইনের মাধ্যমে নদীতে পৌঁছানোর কথা কিন্তু একদিকে নর্দমার পানি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং অন্যদিকে খালগুলো অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। ফলে ভারী বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগা সিটি। ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে ফলে শহরটি তাদের অভ্যন্তরীণ সংস্থান এবং ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাগরিক সুবিধা মোকাবিলা করতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতার মতো হাজারও সমস্যা নাগরিক জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা শহরে বর্ষার সময় (মে থেকে অক্টোবর) পানি দূষণ, যানজট, বায়ু ও শব্দদূষণ, বর্জ্য নিষ্কাশন, কালো ধোঁয়া ইত্যাদির মতো জলাবদ্ধতাও সাধারণ ও নিয়মিত সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এই জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরে যদিও  মুষলধারে ঝড় বৃষ্টিপাতের কারণে ঘটে এবং এ কারণে বেশ কয়েক দিন ধরে রাস্তাঘাট ডুবে থাকে। তবে সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এমনটি হয়ে থাকে। আসলে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অংশে অবস্থানকারী বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালি, সমন্বয়হীনতা, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানারস (বিআইপি)-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত নয় বছরে ঢাকার মহানগর ও এর আশপাশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ভরাট হয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)-এর নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকার ৩৬% জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। তারা আরও বলছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর আওতাধীন নগরীর বিভিন্ন অংশে নয় বছর আগে ১ লাখ ৯৩৭ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে এর মধ্যে ২২% অর্থাৎ ২২ হাজার ১৫৬ একর ভরাট করা হয়েছে, যা প্রতিবছর জলাবদ্ধতা ইস্যুতে ব্যাপক অবদান রাখছে।

বর্ষাকালে ঢাকা শহরে ভারি বর্ষণ হয়, কারণ এটি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। কিন্তু অপরিকল্পিত নগর উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দ্রুত জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে জলাধারগুলোতে এবং প্রাকৃতিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সামান্য হেরফের বা কোন যত্ন না থাকায় প্রাকৃতিক পয়ঃনিষ্কাশন পথগুলোতে নগরীর জলপ্রবাহ সঠিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে না এবং এ কারণে সেসব জায়গায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই শহরের বিভিন্ন অংশ বেশ কয়েক দিন ধরে জলাবদ্ধ হয়ে থাকায় সংশ্লিষ্ট এলাকাটিকে সম্পূর্ণ অচল করে দিচ্ছে। অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্বল্প ধারণক্ষমতা এবং অগভীর সেকেলে ড্রেন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক পলিমাটি, খোলামেলা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ত্রুটিপূর্ণ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিদ্যমান পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং ড্রেন ও পয়ঃনিষ্কাশন পথগুলোতে বর্জ্যের স্তুপ অপসারণ না করা ইত্যাদি জলাবদ্ধতায় বাধার প্রধান কারণগুলোর জন্য দায়ী। এছাড়াও, মৌসুমি জোয়ারের প্রভাব এবং শহর অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থানও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।

ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানির পাম্প, খাল এবং নদীগুলো মোট সাতটি সরকারী সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়: বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা জেলা প্রশাসন, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা), ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রতিটি সংস্থা পৃথকভাবে কাজ করে কিন্তু কারও সাথে কারও সমন্বয়, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও সহযোগিতার লেশমাত্র নেই।

ঢাকা ওয়াসা পানির ড্রেন সিস্টেমে কাজ করে যা ভূপৃষ্ঠের পানিকে পরিচালনা করে। অনিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে ঢাকার বেশিরভাগ ড্রেনগুলো ভারী বর্জ্য এবং প্লাস্টিকের আবর্জনায় আবদ্ধ। এই জলাবদ্ধতা ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের জন্য  বিরাট বোঝা এবং বৈরী সামাজিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব তৈরি করে। ট্রাফিক চলাচল এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে, স্থাপত্য এবং অবকাঠামোর ক্ষতি করে, গাছপালা এবং জলজ প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস করে, মানুষের আয় রোজগারের ক্ষতি করে এবং নগরবাসীর জীবনে জলাবদ্ধতা নানাভাবে প্রভাবিত করে। বৃষ্টির পানি দূষিত হয়ে যায় কারণ এটি ভারী বর্জ্য, ক্লিনিকাল বর্জ্য, পলি, দূষক, গার্হস্থ্য বর্জ্য এবং অন্যান্য মানবিক ক্রিয়াকলাপের সাথে মিশ্রিত হয় যা পানিবাহিত রোগগুলোকে বাড়িয়ে তোলে। আবদ্ধ বৃষ্টির পানির ফলে রোগজীবাণুর বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অস্বাস্থ্যকর ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।

নির্মম সত্য হচ্ছে ঢাকা শহরজুড়ে ৬৫টি প্রাকৃতিক খাল ছিল, কিন্তু বর্তমানে এ সংখ্যা মাত্র ২৬, কারণ তাদের বেশিরভাগই আবর্জনায় ভরপুর ও অবৈধ দখলদারদের দখলে। নগরটি এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে পানি ব্যবস্থাপনার কোন পরিকল্পিত সংযোগ বিবেচনা করা হয়নি। বর্তমানে এর কোনো সুষ্ঠু ও যথাযথ কোনো স্বল্পমেয়াদি প্রতিকারও নেই। এ মেগা-সিটিতে উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে প্রাকৃতিক সংযোগগুলো ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে উঠেছে এবং এটিকে একটি কংক্রিট জঙ্গলে পরিণত করা হয়েছে। এখন এটি প্রথমে সমস্ত বিদ্যমান জলাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করতে হবে এবং তারপরে কালবিলম্ব না করে সমস্ত খাল অবৈধ দখলকারীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং এগুলোর সংযোগ পুনরায় প্রতিস্থাপন করতে হবে, যাতে শহর থেকে পানিপ্রবাহ সঠিকভাবে নিষ্কাশন করতে সহায়তা করে।

ঢাকা সিটি করপোরেশন উভয়ই বলেছিল অবৈধভাবে দখলকৃত সিটি খালগুলো ঢাকা বাঁচাতে পুনরুদ্ধার করা হবে, কারণ খালগুলো ব্লক করা জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। ইতোমধ্যে কিছু খাল পুনরুদ্ধার করা হয়েছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। ঢাকায় ১২% জলাধার থাকার কথা ছিল যা এখন মাত্র ৩%। সমস্ত পুকুর এবং জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নও সমস্যা সৃষ্টি করেছে, কারণ ঢাকার মোট ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ৩৩০ বর্গকিলোমিটার ইতিমধ্যে ঘরবাড়ি, জলের প্রবাহের পথে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন সমস্যার ক্ষেত্রগুলো যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের পথ খোঁজা হয়, তবে সঠিক সমাধান খুব কঠিন নয়। মূল সমস্যাটি হলো বক্স কালভার্টগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পানি খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয় - সম্ভবত স্বাভাবিক প্রবাহের গতিতে ৫-১০% এ হতে পারে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশিরভাগ সিটি খাল অবৈধভাবে ঢাকা ওয়াসার দখলে চলে গেছে এবং বাকি খালিগুলো নিয়মিত পরিষ্কারও হয় না। জলাবদ্ধতা মোকাবেলার জন্য জনসেবা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমন্বয় এবং জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে।

জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে ঢাকা শহরের সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা বর্তমানে নগর কর্তৃপক্ষের পক্ষে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। সুতরাং, জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য নগর নিষ্কাশন ব্যবস্থার কার্যকর পরিচালনা এবং টেকসই পরিচালনার জন্য নগর কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং সরকারী ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

 

লেখক : ব্যাংকার ও মুক্তগদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads