• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

করোনায় গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতি গুরুত্ব দিন

  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২১

আবদুল হাই রঞ্জু

 

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবলে গোটা বিশ্বই আজ স্তম্ভিত। জীবন ও জীবিকার লড়াই চলছে সর্বত্রই। করোনার প্রথম ঢেউয়ে গোটা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সংক্রমণ ও মৃত্যু অস্বাভাবিক থাকলেও তুলনামূলক বাংলাদেশের সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কম ছিল, বিশেষ করে করোনার প্রথম ঢেউ ছিল রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। এতে ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা বন্ধ থাকলেও গোটা দেশেই কম-বেশি সবকিছুই চালু ছিল। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর উল্লেখযোগ্য কোনো চাপ পড়েনি। আর দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা ধারণা ছিল, করোনা গ্রামের মানুষকে সংক্রমিত করবে না! কিন্তু বিধি বাম। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত হেনেছে পুরো গ্রামীণ জনপদে। এখন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক অবস্থার দিকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ভারতের করোনার ভ্যারিয়েন্ট ছিল ভয়ানক। ভারতে আক্রান্ত প্রতি চারজনের মধ্যে একজন করোনায় মারা গেছেন। সে কী এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়! লাশ সৎকার করার মতো পরিস্থিতিও ভারতে ছিল না। অনেক সময় মাঠে-ময়দানে অস্থায়ী চিতা করে লাশ দাহ করা হয়েছে। এমনকি শোনা গেছে, লাশ নদীতে ভাসিয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। সেই ভয়াবহ করোনার ভ্যারিয়েন্ট এখন উত্তরাঞ্চলের জেলা ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অনেক আগেই আক্রান্তের শীর্ষে চলে গেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বাধ্য হয়ে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করেছে। যেখানে পুলিশ, আনছারের পাশাপাশি বিজিবি এবং সেনাবাহিনীকে মাঠে নামতে হয়েছে, তবুও যেন মানুষের বোধোদয় হচ্ছে না। মানুষ এখনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, মুখে মাস্ক ব্যবহার করছে না, যদিও সবার পকেটে পকেটে মাস্ক থাকে। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক দেখলেই মাস্ক পরে, আবার দূরে সরেও যায়। তারা চলে গেলে আবার মাস্কহীন অবস্থায় জটলা বেঁধে গল্পগুজব করা। বাস্তবে সচেতনতাই পারে এই মহামারি থেকে মানুষকে বাঁচাতে। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে চলা জরুরি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা উপেক্ষিত থাকছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষত এবার দগদগে ঘায়ের মতোই স্পষ্ট হচ্ছে। কারণ গ্রামীণ বিশাল বাজারের ভোক্তাদের কাছে পণ্যের চাহিদা থাকার কারণে অর্থনীতির গতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পল্লী অঞ্চলে প্রকট হওয়ায় পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদাতে আঘাত হানার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে ঢাকার উৎপাদন স্বাভাবিক থাকলেও এবার গোটা দেশে চাহিদার ঘাটতির কারণে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কারণ মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ১৪ কোটি লোকের বসবাস গ্রামে। সেই গ্রামে যদি ব্যবসা-বাণিজ্য না থাকে, তাহলে অর্থনীতি যে গতি হারাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

গত ২৯ জুন ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারিতে অর্থনীতিতে ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার কারণে আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। তবুও আমরা অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছি মর্মে তিনি দাবি করে বলেন, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবিকার সুযোগ অব্যাহত রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এমনকি দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছি। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২৩ প্যাকেজের এক লাখ ৪৪১ কোটি টাকা ২১ মে পর্যন্ত ৭১.৫০ শতাংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬ কোটি ৫ লাখ ব্যক্তি এবং এক লাখ ছয় হাজার প্রতিষ্ঠান সরকারের এসব উদ্যোগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাবে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকের আয় কমে গেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক, জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএন উইমেন এবং নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, গত বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে দেশের ৭৭ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় কমে গেছে। একই সময়ে ৩৪ শতাংশ পরিবারে কেউ না কেউ চাকরি অথবা আয়ের ক্ষমতা হারিয়েছেন। মূলত কোভিড-১৯-এর কারণে জনমিতিক ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনসমূহ নতুন পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনটি গত ২৩ জুন এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে বলা হয়, মহামারি করোনা ভাইরাসের আঘাতে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। জরিপে বলা হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে বসবাস করে কিন্তু দেশের যে কোনো অভিঘাতে দরিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারে, তাদেরই নতুন দরিদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। প্রকৃত অর্থে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার সংখ্যা সংস্থা দুটির উল্লিখিত সংখ্যার চেয়ে বেশি হতে পারে।

প্রকৃত অর্থে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় অচল। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বড় অংশ এনজিও নির্ভর ঋণের ওপর অনেকাংশেই গতিশীল। কোভিড-১৯ গত বছরের মার্চে শুরু হওয়ার পর থেকে এনজিওভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে এনজিওভিত্তিক ঋণে ছোট ছোট ব্যবসার পাশাপাশি অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক খাতে ঋণ নিয়ে নিম্ন-আয়ের শ্রমজীবী মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে এবং এনজিও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে থাকে। এমনিতে এসব ছোট ছোট যানবাহনের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ পরিবারের আয় রোজগার বলতে গেলে প্রায় বন্ধ। ফলে সরকারের নির্দেশে বেশ কয়েক মাস এনজিওর কিস্তি আদায়ও বন্ধ ছিল। পরিবহন সেক্টরের অবস্থাও তথৈবচ। সে সেক্টরে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। সে খাতের আয় রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ৭০ লাখ পরিবহন খাতের শ্রমিকের পরিবারের দুর্দশার শেষ নেই! এরই মাঝে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ব্যাটারি ও মোটরচালিত এসব ছোট ছোট রিকশা চলাচলে বাধা প্রদান করে প্রায় ৫০/৬০ লাখ পরিবারের জীবন-জীবিকাকে স্থবির করে দেওয়া হয়েছে। যে মুহূর্তে দূরপাল্লার এবং আন্তঃজেলা বাস চলাচল প্রায় বন্ধ, সে মুহূর্তে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের নামে নিম্ন-আয়ের শ্রমজীবী মানুষের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার এ খাতের উপর প্রশাসনের এহেন আচরণে দেশবাসী ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। কারণ এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দেশে রাতারাতি আসেনি। এসব বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে। সরকার কেন এসব আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। কেনই বা গরিব অসহায় শ্রমজীবী মানুষকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তিতে এসব কেনার সুযোগ দিল। এসব তো গরিব মানুষের জানার কথা নয়। গোটা দেশে লাখ লাখ অটোরিকশা, ইজিবাইক বিক্রি হয়েছে। আমদানিকারকরা এবং করপোরেট গ্রুপের ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করার পর এসব বন্ধের সিদ্ধান্ত এলো। এটাই একটি পুঁজিবাদি অর্থনীতির দেশের রাষ্ট্র কাঠামোর বাস্তব চিত্র। আর যাহোক, করোনা মহামারির ছোবলে যখন দেশের অর্থনীতি রুটি-রুজি হুমকির মুখে, তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ আত্মঘাতীই হয়েছে। আমরা অনুরোধ করব, এই মুহূর্তে এই কঠোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হোক এবং এসব বিলুপ্ত না করে যন্ত্রবিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ইজিবাইক, অটোরিকশাগুলোকে আরো আধুনিকায়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখা হোক।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প। বাকি দুই শতাংশ শিল্প হচ্ছে গার্মেন্টস এবং ফার্মাসিউক্যালস খাত। করোনার বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যদিও সে সংকট অনেকাংশেই কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখছে এই খাত। মূলত পোশাক খাতের প্রতিযোগী দেশ মিয়ানমারে সেনা শাসন ও ভারতের করোনা মহামারির কারণে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে আসা শুরু করেছে। সে মুহূর্তে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষ পর্যন্ত আমাদের পোশাক খাতকেও বিপর্যস্ত করতে পারে। যদিও সরকার বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে লকডাউন, শাটডাউনের সময়েও পোশাক শিল্পকে আওতামুক্ত রেখে উৎপাদন অব্যাহত রাখার কৌশল নিয়েছে। এ কৌশল যথাযর্থই এবং সময়োপযোগী, এতে কোনো দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তবে যানবাহনের অভাবে পোশাককর্মীদের কারখানায় যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবুও তারা কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো দিক। বিশেষ করে করোনার এই মহাদুর্যোগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সবদিক বিবেচনায় নিলে আমাদের দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল, তা সর্বনাশা করোনার ছোবলে অনেকটাই বিপর্যস্ত অবস্থার মুখে পড়তে পারে। তবে আমরা আশাবাদী, অন্ধকার যতই ঘনীভূত হবে আলোর সম্ভাবনা ততোই এগিয়ে আসবে। প্রত্যাশা রাখছি, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেমন দেশের মানুষকে চলতে হবে, তেমনি ভ্যাকসিন প্রয়োগ ব্যতীত এ সংকট মোকাবিলা করা আদৌ সম্ভব হবে না। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলছেন, যত টাকাই লাগুগ সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা হবে। তবে কথার মালা গেঁথে নয়, বাস্তবমুখী সঠিক পদক্ষেপটিই নিতে হবে। অস্বীকার করার উপায় নেই, শুরু থেকে ভ্যাকসিন কেনার ক্ষেত্রে আরও উদার এবং বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ছিল। কথায় আছে, ‘সময়ের এক ফোর অসময়ের দশ ফোর’। অর্থাৎ শুধু ভারতমুখী না হয়ে নগদ টাকায় বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্যাকসিন কেনা উচিত ছিল। কারণ যেখানে আমাদের কেন্দ্রীয় রিজার্ভের পরিমাণ অনেক বেশি। তখন রিজার্ভ থেকে ঋণ নিয়ে হলেও দ্রুতই ভ্যাকসিন কেনা উচিত ছিল। এখন প্রতিটি মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা জরুরি। তা না হলে, করোনার এই মহামারি রোধ করে দেশের সম্ভাবনাময় অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া অনেকাংশেই কঠিন হবে।

 

লেখক : সমাজ বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads