• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

‘সদ্গুণই জ্ঞান’

  • প্রকাশিত ১০ জুলাই ২০২১

অলোক আচার্য

 

জ্ঞান একটি বিস্তৃত শব্দ। এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জ্ঞান এক কথায় হলো পরিচিত থাকা, কোনো কিছু সম্পর্কে বা কারো বিষয়ে জেনে থাকা বা বুঝে থাকা, হতে পারে কোনো কিছুর প্রকৃত অবস্থা, তথ্য, বিবরণ বা গুণাবলি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, যেটি অর্জিত হয়েছে উপলব্ধির মাধ্যমে, অনুসন্ধানের মাধ্যমে বা শিক্ষা গ্রহণের ফলে অভিজ্ঞ হওয়ায় বা পড়াশোনা করে। মানুষ জন্ম গ্রহণের পর থেকে এর শুরু আছে, তবে শেষ নেই। জ্ঞান অর্জন একটি অন্তহীন ধারণা। জ্ঞানপিপাসুরা এই অন্তহীন ধারণার পেছনে ছুটে বেড়ান। জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি আরো বেশি অতৃপ্ত হয়ে ওঠে। আরো বেশি জানার ইচ্ছা তার হূদয়কে তাড়িত করে। তার হূদয় আরো তৃষিত হতে আরম্ভ করে। যদি কেউ মনে করেন, জ্ঞান অর্জন প্রক্রিয়াটি শেষ হয়েছে তাহলে তার জ্ঞান সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থেকে গেল। এই অসীম মহাবিশ্ব যেমন প্রসারিত হচ্ছে, জ্ঞানের ধারণাটিও ক্রম প্রগ্রসরমাণ। এই বিশাল মহাবিশ্বের সম্পর্কে মানুষের জানার চেষ্টা যেমন অবিরত রয়েছে, কিন্তু বাস্তব অর্থে কোনো কূলকিনারা পায় না, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই। এর আদি-অন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। জ্ঞান অর্জনে মানুষ প্রশন্তির খোঁজ পায়। এই জ্ঞান অর্জন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শিশু জন্মের পর থেকেই শিখতে আরম্ভ করে। শিশুর ভাষা এবং আচরণিক দক্ষতা আয়ত্ত করতে থাকে। যখন সে পরিবারের বাইরে যায় তখন তার সামাজিক মিথস্ক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তার জ্ঞান আহরণের উৎসের পরিধি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে নানা উৎস থেকে জানতে পারে, বুঝতে পারে এবং শিখতে পারে। তার মনে প্রশ্ন জাগে। প্রশ্ন করার অর্থই হলো কোনো বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা। যে যত বেশি প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবে, সে তত বেশি বিষয়ে সমাধান করতে সক্ষম হবে। আধুনিক সময়ের অধিকাংশের ভ্রান্ত ধারণা হলো জ্ঞান অর্জনের প্রধানতম এবং একক উৎস হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা।

সভ্যতার অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণা আরো দৃঢ় হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আরম্ভ হয় শৈশবে। একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে তা সমাপ্তও হয়। ভ্রান্ত ধারণা হলো, যে যত বেশি শিক্ষিত সে তত বেশি জ্ঞানী। যার যত বেশি ডিগ্রি রয়েছে সে তত বেশি জ্ঞানী। এই ভ্রান্ত ধারণাই আজকের সমাজে বিকশিত হচ্ছে। জ্ঞান মূলত বইয়ের পাতায় আবদ্ধ থাকে না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের একটি মাধ্যম মাত্র। বইয়ের চেয়ে মানুষ বাস্তব অভিজ্ঞতায় একটি স্থায়ী ও জীবনলব্ধ জ্ঞান লাভ করে। ফলে কে কত জ্ঞানী তার ধারণা তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরিমাপে পাওয়া সম্ভবপর নয়। প্রকৃত জ্ঞানী কে? সে প্রশ্নের উত্তর জানা এ কারণেই বেশ কঠিন। একজন জ্ঞানী তার জ্ঞানচর্চা সর্বদাই অব্যাহত রাখেন, থামান না। জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য কোনো বড় চাকরি করা না, ব্যবসা করা নয়, বরং এর প্রকৃত উদ্দেশ্য শুধুই জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানা।

জ্ঞানের প্রচুর উৎস থাকলেও আমাদের আহরণের সীমাবদ্ধতার দরুণ আমরা তা হূদয়ে ধারণ করতে পারি না। আমরা বইয়ের পাতায় জ্ঞান খুঁজছি অথচ জ্ঞান ছড়িয়ে আছে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানে। জ্ঞান আছে আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে। জ্ঞানের উৎস পৃথিবীর প্রতিটি উপকরণের সঙ্গে জড়িত। আমরা আমাদের ভুল ধারণা এবং অজ্ঞতার জন্য সেই জ্ঞান আহরণ করতে পারছি না। এটাও এক ধরনের অজ্ঞতা। আমরা ডুবে আছি সেই অজ্ঞতায়। মনকে বেঁধে রেখে জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। লেখাপড়া যে জ্ঞানের মাপকাঠি হতে পারে না তার উদাহরণ অসংখ্য। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, কিন্তু পৃথিবীতে তারা জ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শিক্ষা বিষয়টিই যার হাত ধরে বিস্তৃত হয়েছিল সেই শিক্ষাগুরু সক্রেটিস জ্ঞান সম্পর্কে বলেছেন, ‘একমাত্র সত্যিকারের জ্ঞান হচ্ছে সেটা জানা যে তুমি কিছুই জানো না।’ সমাজে আজ সবজান্তা মানুষের সংখ্যাই বেশি! জ্ঞানী ব্যক্তি কোনোদিন তার জ্ঞান নিয়ে তর্কে জড়ান না।

সক্রেটিস আমৃত্যু জ্ঞান সাধনা ও বিতরণ করে গেছেন। তার হাত ধরে আরো বহু জ্ঞানী মানুষ সমাজকে আলোকিত করেছেন। জ্ঞান কখনো অহংকারের জন্ম দেয় না বরং অহংবোধকে ধ্বংস করে। অথচ আজকের সমাজ অহংকারী মানুষের পদচারণায় মুখর। তাদের শিক্ষা, সম্পদ এবং ক্ষমতা নিয়ে অহংকার পৃথিবীতে দ্বন্দ্বের সংঘাত সৃষ্টি করছে। প্রকৃত জ্ঞান কোনোদিনই মানুষকে ক্ষমতালিন্সু করে না, অহংকারী করে না। জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী করে।  জ্ঞান মানুষকে সত্যের রাস্তা দেখায়। আরো জ্ঞান অর্জনে ব্রতী করে। এখন আমি কিছুই জানি না—এই ধারণা মনে পোষণ করা মানুষের সংখ্যা নেই বললে ভুল বলা হবে না। বিপরীতে আমিই সব জানি এমন ধারণাই সর্বমহলে প্রতিষ্ঠিত। জ্ঞান যাচাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে সামনে সার্টিফিকেট দেখাবে। আমরা সবাই মহা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের কথা জানি। তার মাধ্যাকর্ষণ বল আবিষ্কারের কথা জানি। তার নিজের সম্পর্কে একটি বিখ্যাত মন্তব্য রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না বিশ্ব আমায় কীভাবে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু আমার চোখে আমি কেবলই এক ছোট বালক যে সমুদ্র উপকূলে মনের আনন্দে খেলে বেড়িয়েছে আর কখনো কখনো একটু বেশি মসৃণ নুড়ি-পাথর কিংবা সুন্দর ঝিনুক খুঁজে পেয়েছে। এদিকে সত্যের মহাসমুদ্র আমার সামনে অনাবিষ্কৃতই থেকে গেল।’

জ্ঞান বস্তুত এরকমই এক মহাসমুদ্র। যে রাজ্যে একবার ডুব দিলে তার তল খুঁজে পাওয়া যায় না। কেবলই জানতে ইচ্ছে করে। এই জানার প্রক্রিয়ায় নিজেকেও জানতে হয়। নিজেকে না জানলে অন্যদের জানার চেষ্টা বৃথা। এ কারণেই সেই বিখ্যাত উক্তি—‘নিজেকে জানো।’ আমরা নিজেকে তো নয়ই, কারো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী নই। আমরা মুখস্থ করছি, চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বড় বড় অফিসার তৈরি করছি। কিন্তু সমাজে প্রকৃত জ্ঞানী কতজন তৈরি করতে পারছি? যারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন সত্যের দিকে, সুন্দরের দিকে। এ বিষয়ে আরো একটি ঘটনা আছে যা আমাদের জ্ঞানের বিপরীত চর্চার দিকে ইঙ্গিত দেয়। আমরা যেমন বিজ্ঞানী নিউটনের কথা জানি, তেমনি জানি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথাও। একদিন আইনস্টাইনের এক সহকর্মী তার টেলিফোন নম্বরটা চাইলেন। আইনস্টাইন তখন একটি টেলিফোন বই খুঁজে বের করলেন এবং সেই বই থেকে তার নিজের নম্বরটা খুঁজতে লাগলেন। সহকর্মী তাকে বললেন, ‘কী ব্যাপার, নিজের টেলিফোন নম্বরটাও মনে নেই আপনার?’ আইনস্টাইন বললেন, ‘না। তার দরকারই বা কি? যেটা আপনি বইতে পাবেন, সে তথ্যটা মুখস্থ করে মস্তিষ্ক খরচ করবেন কেন?’

অথচ আমরা ঠিক এই কাজটাই করছি। মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখছি মুখস্থ করতে গিয়ে। যে তার মস্তিষ্কে যত বেশি তথ্য রাখতে পারছে সে তত জ্ঞানী! চিন্তার সুযোগ সেখানে কমই থাকছে। এটা হলেই ভালো চাকরি জুটছে, অন্যথায় নয়। চাকরি না হলে সমাজ তাকে জ্ঞানী বলছে না, ভবঘুরে বলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করছে। ফলে কেবল নিখাদ জ্ঞানচর্চা করে সময় কাটানোর কোনো উপায় নেই। আজ সমাজে ভুল ধারণা হলো এই যে, আমি জ্ঞানী এবং আমার জ্ঞানের দরকার নেই। এ বিষয়ে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন, ‘জ্ঞানী লোকদের পরামর্শ লাগে না, নির্বোধরা পরামর্শ শোনে না।’ আজ কে কত জ্ঞানী তা নিয়ে প্রচারেই ব্যস্ত থাকছে কিছু মানুষ। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা ভারী হচ্ছে। আমাদের চারপাশে জ্ঞানের বিশাল সব উৎসকে অবজ্ঞা করে চলেছি। আমাদের প্রয়োজন নেই এই অজুহাতে তা এড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয় ব্যবহার করে জ্ঞান লাভ করতে পারি। জ্ঞান লাভের নির্দিষ্ট কোনো স্থান নেই, সময় নেই। যে-কোনো স্থানেই আমরা তা অর্জন করতে পারি। আবারো মনে পড়ছে মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের সেই অমর বাণী, ‘সদ্গুণই জ্ঞান।’ আজকে সেই ‘সদ্গুণে’র মানুষের বড় অভাব। তাই জ্ঞান আহরণের প্রকৃত জ্ঞানীর বর্তমান পৃথিবীতে বড় অভাব।

 

লেখক : সাংবাদিক ও মুক্তগদ্য লেখক

sopnil.roy@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads