• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

উন্নত দেশ গড়তে শিশু ও নারীর উন্নয়ন জরুরি

  • প্রকাশিত ১২ জুলাই ২০২১

শেগুফতা শারমিন

 

বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত বাংলাদেশ উপহার দেওয়া। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেক্টরভিত্তিক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন আছে এবং ভবিষ্যৎ রূপরেখা অনুযায়ী মহাপরিকল্পনাসমূহও বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীদের সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন।

২০০৯ থেকে ২০১৮ সময়কালে নারী ও শিশু উন্নয়নে বাংলাদেশ অনুকরণীয় সাফল্য অর্জন করেছে, বিশেষ করে নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থিক সঙ্গতি, পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান রাখা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা, কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নে অংশগ্রহণ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় নারীদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা যেমন সৃষ্টি করেছে, তেমনি তাদের অংশগ্রহণ দেশের জিডিপি হার বৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছে। বিগত এক দশকে বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে যে সফলতা অর্জিত হয়েছে, তা বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান তাদের ক্ষমতায়নে অবদান রেখেছে। জেন্ডার সমতা অর্জনের পথকে সুগম করেছে এবং একই সাথে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে বেগবান করেছে।

World Economic Forum প্রণীত Gender Gap Index ২০১৭, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাপকাঠিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো First Spot in Gender Equality অর্জন করেছে। নারীর অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করে সমাজে ও অর্থনীতিতে নারী এখন প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। বিগত দশকে বাংলাদেশ সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনসহ শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, নবজাতক মৃত্যুহার হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করছে। ২০১৭ সালের The Global Gender Gap Report অনুযায়ী জেন্ডার সমতা আনয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৪৪টি দেশের মধ্যে ৪৭তম হয়েছে। লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এবং পাকিস্তান অনেক পিছিয়ে আছে।

বর্তমান সরকার নারী উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নারী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, শ্রম বাজারে নারী প্রবেশাধিকার, সামাজিক সুরক্ষা, সহিংসতা প্রতিরোধ ইত্যাদি কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নারী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সুবিধার্থে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। দেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত করার প্রয়াসে নারীর উন্নয়নকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে চিহ্নিত করেছে। বিগত কয়েক বছরের গৃহীত পরিকল্পনা কর্মসূচি এবং তার বাস্তবায়ন নারী শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ইতিবাচক হারে উন্নীত হয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারের বৃত্তি প্রদান কর্মসূচি এবং কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস।

বর্তমান সরকারের নারী উন্নয়ন কর্মসূচির সফলতাসহ মেয়েশিশু ও নারী শিক্ষার প্রসারে অবদান রাখার জন্য Global Women's Leadership Award, Planet 50:50, Agent of change Award, Women in Parliament (WIP) Ges WIP Global Forum Award এবং Tree of Peace Award উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিসমূহ আমাদের সফল অগ্রযাত্রার প্রমাণও বটে। বাংলাদেশের নারীরা আজ তৃণমূল পর্যায় থেকে—সামরিক বাহিনী, বিমান, নৌ, পুলিশ, কল-কারখানা, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা—সকল সেক্টরে পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে চলেছে এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে।

 

দুই

 

নবজাতক এবং শিশুমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশ, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অনুকরণীয় ও বলিষ্ঠ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচকে ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসনীয়। এই প্রতিবেদনে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার, শিশুদের স্কুলে পাঠানোর বয়স, শিক্ষার মান এবং শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠাসহ বেশ কয়েকটি সূচক পর্যালোচনা করা হয়েছে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পেলে একটি শিশু প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে শতভাগ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে।

শিশুদের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবসম্পদে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় বর্তমান সরকার বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রতিবছর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিশুরা এগিয়ে তার মধ্যে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সুরক্ষা অন্যতম। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশের সফলতা এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রেখেছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশে একটি শিশু ৪ বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করে এবং গড়ে ১১ বছর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় থাকে। তবে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ায় চার বছরের আগেই ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় শত ভাগ। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফল তা প্রমাণ করে। ছাত্রী উপবৃত্তি, স্কুলে পুষ্টিকর খাবার বিতরণ এবং বিনামূল্যে পাঠ্য পুস্তক বিতরণের ফলে একদিকে যেমন নারীশিক্ষার হার বেড়েছে, তেমনি ঝরেপড়ার হার উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ চিত্রের আরো পরিবর্তন অবশ্যই করতে হবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য।

বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রযাত্রায় উন্নয়নের মহাসড়কে দাঁড়িয়ে যে সম্ভাবনাময় উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, সুন্দরভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ, মানসম্মত শিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধ, সহিংসতা প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ রোধ, শিশুদের মতামতকে  প্রাধান্য দেয়া, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রসার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি ব্যবস্থা শতভাগ বা এর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে তা আমাদের আরো সমৃদ্ধিশালী উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সাহায্য করবে। শিক্ষক, অভিভাবক, পরিবার- সবার দায়িত্ব শিশুদের সুরক্ষা দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে একটি সৃজনশীল মানবসম্পদ পরিণত করা।

সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, পুষ্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একটি সৃজনশীল প্রজন্ম গঠনে বদ্ধপরিকর। কারণ নারী এবং শিশুর টেকসই উন্নয়ন দেশের সার্বিক উন্নয়ন ধারার এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্র বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এমন একটি দেশ নিশ্চয়ই আমরা গড়তে সক্ষম হব, যেখানে প্রতিটি নারী ও শিশু তার অধিকার ও সক্ষমতা নিয়ে নিরাপদে সম্ভাবনাময় উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে আমাদের দেশের অব্যাহত উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads