• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

কৃষি চাষাবাদে সৌরবিদ্যুতে গুরুত্বারোপ জরুরি

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১৫ জুলাই ২০২১

এখন বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না। বলতে গেলে বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন অচল। ফলে প্রতিনিয়তই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছেই, যা সামাল দিতে সরকারও তৎপর। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ, অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে সংকট উত্তরণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এমনকি তীব্র বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে অনেক চড়া দরে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনও করে। যদিও কথা ছিল, খুব স্বল্প সময়ের জন্য কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। অন্যান্য প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে গেলে যত দ্রুত সম্ভব কুইক রেন্টাল পদ্ধতির বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করা হবে। কার্যত কুইক রেন্টাল আর কুইকে থাকেনি। নানা অজুুহাতে বছরের পর বছর ধরে বাড়তি মূল্যেই কুইক রেন্টাল পদ্ধতিকে চালু রাখা হয়। এতে জনগণের ওপর করের বোঝাও বেড়ে যায়।

অবশ্য সরকার বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের শত আপত্তির মুখে মান্ধাতা আমলের আদলে পরিবেশ বিধ্বংসী ব্যয়বহুল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কিছু কয়লাভিত্তিক বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যদিও এসব প্রকল্প এখনো পুরোদমে উৎপাদনে আসতে পারেনি। দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর মাতারবাড়ী সমুদ্রপৃষ্ঠের জলাভূমিকে ১০ মিটার উঁচু করে নির্মিত হচ্ছে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা আগামী ২০২৪ সালের আগে উৎপাদনে আসতে পারবে না। এমন আরো কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকার পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসেছে, যদিও ২০৪১ সাল নাগাদ সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ২২টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা ছিল। এই পরিকল্পনার ২২ প্রকল্প নামিয়ে আনা হয়েছে ৭ প্রকল্পে। ইতেমধ্যে বেসরকারি খাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়তে হবে। এ কারণে চলমান প্রকল্পগুলো চলমান থাকলেও আর এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না। শুরু থেকে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসার আহ্বান জানালেও সরকার কর্ণপাত করেনি। বিলম্বে হলেও সরকার পরিবেশ ও অবকাঠামো বিবেচনায় যৌক্তিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। অবশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বৃহৎ প্রকল্পসমূহ বন্ধ কিংবা কমিয়ে আনায় হয়তো আগামী দিনগুলোতে চাহিদার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ঘাটতি হবে, তা অনেকটাই নিশ্চিত, যা মোকাবিলায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গুরুত্বারোপ, বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে জোর দিতে হবে। আর যেহেতু বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা খরচে ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ চললেও উৎপাদনে আসা সম্ভব হয়নি, এরপরও চাহিদার প্রায় পুরোটাই অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে, সেখানে কয়লাভিত্তিক অন্যান্য প্রকল্পসমূহ বন্ধ করায় সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে সরকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োচিত বলে আমরাও মনে করি।

বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলায় সরকারের নানামুখী সহায়তা, যেমন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিতে ভর্তুকি ও কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন জাতের উচ্চফলনশীল ধানসহ খাদ্যশস্যের উদ্ভাবন কৃষিতে অভাবনীয় সফলতা এনেছে। এদেশের চাষিদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় দেশের মানুষের দুবেলা খাবার সংস্থান হচ্ছে। কিন্তু দেশের কৃষকের অবস্থা ভালো নেই। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আগাম বন্যার কারণে ফসলহানি, এমনকি কীটপতঙ্গের আক্রমণে কৃষকের ক্ষেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো খাদ্যপণ্যের একটু বাড়তি উৎপাদন হলেই উপযুক্ত মূল্যের অভাবে কৃষকের কপালও পোড়ে। কৃষি মজুরের সংকটের কারণে অনেক সময়ই চাষিরা নির্বিঘ্নে চাষাবাদ করতেও পারে না। অথচ শত প্রতিকূলতাও কৃষককে থামাতে পারে না। ভোর হলেই চাষিরা মাঠে নেমে যায়। এভাবেই ধান, চাল, সবজি উৎপাদনে দেশ এখন অনেক দূর এগিয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহায়তা পেলে কৃষিতে আরো সমৃদ্ধি আনা সম্ভব। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান কার্যত স্থির। অথচ মানুষ বাড়ছে হুহু করে। মানুষ বাড়ার অর্থ হলো খাদ্য চাহিদাও বাড়তে থাকবে। সবার মুখের আহার জোগান দিতেই হবে। কারণ খাদ্য ব্যতীত মানুষ বাঁচতে পারবে না। এ কারণে স্বল্প সেচে উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন করতে হবে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানিও দেশের অমূল্য সম্পদ। সে পানিও অফুরন্ত নয়। বর্তমানে যে হারে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে, এতে করে নিকট ভবিষ্যতে পানির সংকটেও আমাদের পড়তে হবে। ইতোমধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হুহু করে নিচে নেমে যাচ্ছে। যে কারণে স্বল্প পানিতে চাষযোগ্য উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনের বিকল্প নেই, যদিও ইতোমধ্যে কৃষি বিজ্ঞানীরা স্বল্প সেচের ধান উদ্ভাবন করেছেন। কিন্তু উচ্চফলনশীল জাতের উদ্ভাবিত ধান উৎপাদনেও প্রচুর পানির প্রয়োজন হবে। যা আরো কমিয়ে আনা কিংবা বিনা সেচে উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবনে সরকারকে ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের দেশে তীব্র খাদ্য সংকট ছিল। দেশের অধিকাংশ মানুষকে আধাপেটা কিংবা না খেয়ে বেঁচে থাকতে হতো। সে অবস্থা থেকে উত্তরণে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। একমাত্র সেচভিত্তিক বোরো চাষাবাদের বদৌলতে সে চিত্রপট পাল্টে গেছে। ধানের উৎপাদন বাড়তে থাকে। মানুষের সীমাহীন খাদ্য সংকটও কমে আসে। উৎপাদনের সে ধারা দিনে দিনে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এখন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে সবসময় আর চাল আমদানি করতে হয় না। সুতরাং খাদ্যশস্য উৎপাদন যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এখন বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্যও অনেক বেশি, পাশাপাশি ডিজেলের দামও বেশি। আর বিদ্যুৎ ও ডিজেলচালিত ইঞ্জিন দিয়েই ধানের ক্ষেতের সেচকার্য চালানো হয়। ফলে ধান উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ে। অথচ পরিবেশবান্ধব প্রকৃতিনির্ভর সৌরবিদ্যুতের সংযোগ ধানের মাঠে মাঠে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেক কম খরচেই চাষিরা ধানের জমিতে সেচ দিয়ে ধান উৎপাদন করতে পারবেন। বর্তমানে আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুতের এক বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে গ্লোবাল স্ট্যাটাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাসাবাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। তবে নবায়নযোগ্য শক্তি খাতের বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিনিউঅ্যাবল এনার্জির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সৌরবিদ্যুৎ খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। এখন এর মাধ্যমে দেশের ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা স্রেডার তথ্যমতে, দেশে এখন ২৩টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান আছে। আর এগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ১ হাজার ২২০ দশমিক ৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। স্রেডার দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে সৌর প্যানেল থেকে ৪১৫ মেগাওয়াট, বায়ু থেকে ২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জল বিদ্যুৎ থেকে ২০০ মেগাওয়াট এবং বায়োগ্যাস থেকে দশমিক ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আবার ইতোমধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ অংশীদারি কোম্পানি গঠনে চুক্তি করেছে চীন। ইতোমধ্যে সারা দেশে ১ হাজার ৪৬৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলছে। এমনকি দেশের গ্রিডবহির্ভূত গ্রামীণ এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় ইডকলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা ৫৮ লাখ সোলার হোট সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া দুর্গম চর ও দ্বীপাঞ্চলে সোলার মিনিগ্রিড প্রকল্প বাস্তবায়নেরও প্রক্রিয়া চলছে। ১৯টি মিনি গ্রিড প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বর্তমানে স্রেডার তত্ত্বাবধানে ইডকল মনপুরা দ্বীপকে শতভাগ সোলার প্যানেলের আওতায় এনেছে। এমনকি দেশের সব সরকারি বেসরকারি অফিস ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদে নেট মিটারিং পদ্ধতিতে রুফটপ সোলার সিস্টেম স্থাপনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় ও উত্তরাঞ্চলে যেখানে সুপেয় পানির অভাব, সেখানে ১৫২টি সোলার ড্রিংকিং ওয়াটার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে সুতিয়াখালীতে ১৭৪ একর জমির ওপর ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে গেছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জে ১০০, পাবনার সুজানগরে ৬০ ও বেড়ায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

আবার এও স্মরণে রাখতে হবে, সোলার প্যানেল স্থাপনে ১ শতাংশ আবাদি জমিও যেন নষ্ট না হয়। এ জন্য নদীশাসন করে চরাঞ্চলে স্থায়ীভাবে সোলার গ্রিড স্থাপন করে সঞ্চালন লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। সবদিক বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির এই কর্মযজ্ঞকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে ধানসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদনেও অভাবনীয় সফলতা আসবে। আর এটাই হবে এই মুহূর্তে যৌক্তিক ও সময়োচিত পদক্ষেপ।

 

লেখক : সমাজ বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads