• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

পরমাণু চুক্তি সংকটের সমাধান কোন পথে

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ২৪ জুলাই ২০২১

পৃথিবীতে বহু ধ্বংসাত্মক অস্ত্র আবিষ্কৃত হলেও এখনও মানুষের মনে যে অস্ত্রভীতির সঞ্চার করে তা হলো পরমাণু অস্ত্র। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার যে ভয়াবহতা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে তা কোনোকালেই ভোলার নয়। এরপর থেকেই মূলত বিশ্ব চাইছে শান্তির পথে হাঁটতে। যদিও তা সম্ভব হয়নি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার কারণে। তবে বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো চেয়েছে নিজেদের পরমাণু অস্ত্রের লাগাম টেনে ধরতে। এখন বিভিন্ন দেশের উত্তেজনায় পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার না হলেও মাঝেমধ্যেই তা হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। গুটিকতক দেশের কাছে এখনও যে পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র রয়েছে তা যেকোনো উত্তেজনাবশত ধ্বংসের কারণ হতে পারে। কারণ ক্ষমতার শেষ হলো নিজের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা। ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনোমালিন্যের অন্যতম ইস্যু হলো ইরানের পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধকরণ। প্রায় ঝুলতে থাকা চুক্তিটি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন প্রচেষ্টা হচ্ছে। তবে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি আসেনি। এক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে উভয় দেশের এবং সংশ্লিষ্ট নেতাদের। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং হাসান রুহানির পর এখন জো বাইডেন এবং রাইসি’র মধ্যে কার্যকর আলোচনার ওপর বিষয়টি নির্ভর করছে। ট্রাম্পের সময়ে যে চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক অবনতি ঘটতে থাকে। সেই উত্তেজনা প্রশমনের সমাধান ইরানের পরমাণু চুক্তি মেনে চলা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসা দরকার। আর এসব কিছুর মাঝে প্রয়োজন আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা না হলে সম্পর্কের অবনতি ঘটতেই থাকবে এবং কার্যকর কোনো সমাধানে আসা সম্ভব হবে না। ইরানও তার পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাবেই বলে মনে হয়। জাতিসংঘের আইএইএ একে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলোর ভেতরের কোনো ছবি বা তথ্য দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কলিফ। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সমৃদ্ধকরণ ইস্যুটি নিয়ে দোলাচল যেন কাটছেই না। অবশ্য এই সমস্যা সমাধানে যে কার্যকর সিদ্ধান্ত উভয়পক্ষ থেকে আসা প্রয়োজন রয়েছে সেগুলোও আসছে না। ফলে আপাতত অনিশ্চয়তার ভেতরেই থাকছে এ চুক্তি।

সম্প্রতি আইএইএ বা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, ইরান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ধাতু উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই খবরে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি হাতাশা প্রকাশ করেছে। ইরানের এই পদক্ষেপ আলোচনাকেই ঝুঁকির মুখে ফেললো বলে মন্তব্য তাদের। যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগ ‘পেছন দিকে যাওয়ার দুর্ভাগ্যজনক পদক্ষেপ’ বলে মন্তব্য করেছে। ঘটনাটি এমন সময় সামনে এসেছে যখন তেহরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ আলোচনা শুরু করছে বাইডেন সরকার। তবে ইরান বলছে তারা একটি গবেষণা চুল্লির জ্বালানির জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ধাতু উৎপাদন করছে। ২০১৫ সালের জুনে ভিয়েনায় ইরানের সঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি না করার প্রতিশ্রুতি দেয় তেহরান। চুক্তি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ কাজেই ইরানের এই কর্মসূচি ব্যবহার করার কথা।

ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়েই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইউরেনিয়াম বৃদ্ধির মাধ্যমে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চায়। এর আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরান কখনো পরমাণু অস্ত্রের মালিক হতে পারবে না। সে সময় এসব উত্তেজনার মধ্যেই আগুনে ঘি ঢালার মতো ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধের মাত্রা বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশে উন্নীত করার খবর প্রকাশিত হয় এবং তা আরও বেশি উত্তেজনার সৃষ্টি করে। চুক্তিতে এটি সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ করার কথা ছিল। জো বাইডেনের আগে ক্ষমতায় আসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার প্রথম দিকে ইরানের সাথে সম্পর্ক এতটা সংকটপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর পূর্ব থেকেই পরমাণু এ চুক্তির বিরোধিতা করতো এবং পূর্বসূরি ওবামা আমলে স্বাক্ষরিত এই চুক্তিকে ‘ক্ষয়িষ্ণু ও পচনশীল’ আখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালের মে মাসে তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তেহরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় চালু করে।

পরমাণু সমঝোতায় ইরানকে সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোগ্রাম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ইরান ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত ওই সমঝোতা মেনে চলেছিল। তেহরান বারবার বলে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ফিরলে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে ইরান তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এখন জো বাইডেন আর ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি। রাইসি আগামী ৫ আগস্ট অফিস শুরু করবেন। বিদায়ের আগে বর্তমান হাসান রুহানি বিশ্ব ছয় শক্তির সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে চাচ্ছিলেন। রাইসি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিষয়টি দীর্ঘায়িত হতে পারে। ইব্রাহিম রাইসি কট্টর রক্ষণশীল বলে পরিচিত এবং সেদেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির বেশ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। নির্বাচিত হওয়ার পরই তিনি বলেছিলেন, ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনাকে তিনি স্বাগত জানান কিন্তু এতে অবশ্যই ইরানের জাতীয় স্বার্থের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এ সময় তিনি আরও বলেছেন, ইরানের ব্যালিষ্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আর কোনো দরকষাকষি চলবে না। সেক্ষেত্রে সংকট আরো বাড়বে। রাইসির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আগেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। রাইসি ২০১৯ সালে প্রধান বিচারপতি হন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

জো বাইডেন চুক্তিটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী। যদিও পশ্চিমাদের কেউ কেউ রাইসি প্রেসিডেন্ট হওয়ায় চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্ব রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। রয়েছে নিজ দেশের স্বার্থ। এর আগে এক তথ্যে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ দাবি করেছিল যে, পরমাণু সমঝোতায় যে পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুতের কথা বলা হয়েছিল, ইরান তার ১৬ গুণ ইউরেনিয়াম মজুত করেছে। ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির কথা বরাবরই অস্বীকার করেছে। কিন্তু ইরান যতই অস্বীকার করুক না কেন, যদি তা হয় তাহলে বিশ্ব আবারও পরমাণু অস্ত্রের হুমকিতে পড়বে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বৃদ্ধি করলে তা থেকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। এমনিতেই বিশ্ব পরমাণু অস্ত্র নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা নিক্ষেপের পর থেকেই বিশ্বের মানুষের প্রত্যাশা পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকিমুক্ত বিশ্ব। পরমাণু অস্ত্রধর দেশগুলো তাদের পরমাণু অস্ত্র কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। ইরান যদি নতুন করে পরমাণু অস্ত্রধর দেশ হয়, তাহলে পারমাণবিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করবে বৈ কমবে না। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে থামাতে একের পর এক অবরোধ আরোপ করেছে। তবে এসবকে থোরাই কেয়ার করে ইরান তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন সামরিক তৎপরতা দুই দেশের ভেতর অধিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।

তবু বিশ্ব নেতারা এখন পারমাণবিক অস্ত্র ঝুঁকিমুক্ত পৃথিবীর দিকে এগুতে চাচ্ছেন। কিন্তু যা ঘটার ঘটে গেছে। বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশের সংখ্যা এক দুই করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে নতুন করে পরমাণু অস্ত্র তৈরির বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। পরমাণু সমঝোতার এই পরিণতির জন্য যাকেই দোষারপ করা হোক না কেন সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এর জন্য যে আলোচনাই উত্তম সমাধান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরমাণু চুক্তির বাস্তবায়ন করাও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বিশ্ব শান্তিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখতে হলে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা আবশ্যক।

 

লেখক : সাংবাদিক

sopnil.roy@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads