• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

রপ্তানিমুখী চামড়াশিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৬ জুলাই ২০২১

মো. জিল্লুর রহমান

 

আমাদের রপ্তানি শিল্পের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প। পোশাকশিল্পের পরই এ শিল্পের অবস্থান। রপ্তানি আয়ের প্রায় নয় শতাংশ আসে চামড়াশিল্প থেকে। আর এক্ষেত্রে প্রতি বছর কোরবানি ঈদের সংগ্রহ এ শিল্পে বয়ে আনে বাড়তি প্রণোদনা। নানাবিধ কারণে দেশের চামড়াশিল্পে দুর্দিন চলছিল বেশ কয়েক বছর থেকেই। এর মধ্যেই শিল্প খাতটিকে আরো দুর্দশায় ফেলেছে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও তাণ্ডব। টানা তিন বছর বিপর্যয়ের পর এবার চামড়ার দাম কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করা হয়েছিল। পশু কোরবানি দেওয়ার পর থেকেই মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন। আশার আলো দেখছেন ট্যানারি মালিকরাও। রপ্তানি খাতেও গত অর্থবছর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এ খাতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, নানামুখী সংকটে নিমজ্জিত রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রতি বছরের মতো এবারও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোরবানির পশুর চামড়ার দাম পুনর্নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে গতবারের চেয়ে একটু দাম বাড়িয়ে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। লবণজাত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৪০-৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩-৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর ঢাকায় ৩৫-৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ছিল ২৮-৩২ টাকা।

তবে আশার কথা হচ্ছে, গত তিন মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম একটু বাড়তির দিকে এবং এরই মধ্যে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চামড়ার চাহিদা বাড়ছে। ফলে গতবারের চেয়ে এবার চামড়ার দাম বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এজন্য মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দাম দেখে সতর্ক হয়ে চামড়া সংগ্রহ করছেন। অন্যদিকে সরকারি তথ্য বলছে, চার বছর পর সদ্য সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছর প্রবৃদ্ধিতে ফিরেছে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব থাকলেও এর প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এ কারণে রপ্তানি আদেশও বেড়েছে।

কাঁচা চামড়ার দামে বিপর্যয় শুরু হয় মূলত ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালে গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ এবং খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০-২২ টাকায় নেমে আসে। গত দুই বছর তা আরও নিম্নমুখী হয়েছে। গতবছর সরকার গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছিল ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০, ঢাকার বাইরে ২৮-৩২ টাকা এবং খাসির চামড়ার দাম ১৩-১৫ টাকা। গতবছর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা মাটির নিচে পুঁতে ফেলার ঘটনা ঘটেছিল। পানিতে ও রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়েছিল। কোনো কোনো এলাকায় একেবারেই চামড়ার ক্রেতা পাওয়া যায়নি। এর আগের বছরও একই ঘটনা ঘটেছিল।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়; এর অর্ধেকের বেশি সংগ্রহ করা হয় কোরবানির ঈদের সময়। মোট চামড়ার ৬৪.৮৩ শতাংশ গরুর, ৩১.৮২ শতাংশ ছাগলের, ২.২৫ শতাংশ মহিষের এবং মাত্র ১.২০ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। ২০১৪ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৮৫-৯০ টাকা থাকলেও এ বছর তা ৪০-৪৫ টাকা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১-এ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। ফলে বছরের ব্যবধানে রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ আয় আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে চামড়াশিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয়।

মূলত এরপর থেকেই বিপর্যয় নামে এ খাতের রপ্তানিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে ১০২ কোটি ডলারে নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। উল্লেখ্যযে, করোনাকালের আগের বছর ২০১৯ সালে দেশে কোরবানি পশুর চামড়া নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দাম না পেয়ে ১০-১৫ শতাংশ গরুর চামড়া সড়কে ফেলে এবং মাটিতে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আবার সময়মতো লবণ না দেওয়া, বৃষ্টি ও গরমের কারণেও ২০ শতাংশ গরুর চামড়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

যারা কোরবানি করেন তারা ধর্মীয় বিধি মেনে সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কেনেন এবং কোরবানি করেন। পশুর চামড়া বিক্রি করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তা গরিব মিসকিন, অসহায় নারী-পুরুষ, অভাবী লোকজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের মাঝে অর্থ বিতরণ করেন। তবে উল্লেখযোগ্য অংশের পশু চামড়া সাধারণত বিভিন্ন এতিমখানা, অনাথ আশ্রম, মসজিদ, মাদরাসায় দান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করে লব্ধ অর্থ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রী এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় করেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রচলিত এই নিয়মে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলেননি। সুতরাং যদিও কোরবানির পশুর চামড়ার সরবরাহকারী আপাতদৃষ্টিতে কোরবানিকারী ধর্মপ্রাণ মুসলিম, কিন্তু এর বিস্তৃত সুবিধা পায় সমাজের একটি সুবিশাল জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় রীতি মেনে কোরবানি করা ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তাই খুব বেশি দর কষাকষির অবস্থানে থাকেন না।

ইসলামের নির্দেশানুসারে কোরবানির চামড়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয় অথবা এতিমখানায় দান করা হয়। পক্ষান্তরে, পশু চামড়ার ক্রেতা বা চাহিদার দিকটি সুবিস্তৃত। এখানে পশু চামড়া অনেক শিল্প পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। অতি প্রয়োজনীয় জুতা থেকে শুরু করে বিলাসী জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য দেশ বিদেশের বাজারে খুবই আকর্ষণীয়। অনেক চামড়াজাত পণ্য অতি প্রয়োজনীয় বিধায় এগুলোর চাহিদা তেমন কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বাড়লে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির মতে, বাংলাদেশের বাজারে একবার কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সাধারণত আর কমে না। যখন কোনো পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়, তখন শুধু কাঁচামাল নয়, অনেক বিষয় বিবেচনা করেই সেটির দাম নির্ধারিত হয়। যেমন- কারখানার ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, শ্রমিক বেতন ইত্যাদি। কাঁচামালের দাম কমলেও সেগুলো তো কমেনি। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের ভোক্তাদের অধিকার না থাকার কারণে। ফলে পণ্যের উৎপাদকরা যে দাম নির্ধারণ করেন, সেটাই গ্রহণ করতে হয়। তাদের উৎপাদন খরচ কমলো কি-না, সেটা আর যাচাই করা হয় না। সেটা শুধু চামড়াজাত পণ্যই নয়, অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে। এজন্য ভোক্তারা তাদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হলে আর ভোক্তা অধিকার আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এ পার্থক্য কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।

উদাহরণস্বরূপ, আগে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেত তাদের বইখাতা হাতে করে নিয়ে। পরে তারা বিভিন্ন পলিথিনের ব্যাগে করে বইখাতা বহন করত। কিন্তু বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছেলেমেয়েরা বই খাতা কাপড় বা অনেকে চামড়ার তৈরি ব্যাগে করে নিয়ে স্কুলে যায়। এটি ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির বহিঃপ্রকাশ। এসব কারণেই দেখা যায় চামড়াজাত পণ্যের বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল। তাই চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদনকারীরা বছর বছর পণ্যের দাম বাড়লে, উল্লেখযোগ্য মুনাফা করে এবং করার কথা।

এদেশে চামড়াশিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫১ সালে ৩ অক্টোবর। নারায়ণগঞ্জ থেকে সরকার চামড়াশিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগে নিয়ে আসে। কিন্তু এখানে বর্জ্য শোধনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলত। ফলে বছরের পর বছর বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত হয়েছে। পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য সরকার ২০০৩ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে সাভারে বিসিকের তত্ত্বাবধানে চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন করে। এতে করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর এ শিল্পের দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

কিন্তু শুধু চামড়াশিল্প নয়, করোনার কারণে অনেক ব্যবসায় এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ চলছে। কারণ চামড়াশিল্প ২০১৫ সাল থেকেই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কোনো মতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। বিসিকের কিছু সিদ্ধান্তহীনতা, সময়মতো সরকারের প্রণোদনা না পাওয়া এবং নীতিগত সহযোগিতা না পাওয়ায় ইউরোপ আমেরিকার বাজার ধরতে পারছিল না। তার ওপর দুই বছর করোনার প্রভাবে ব্যবসাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

মন্ত্রণালয় এবারও কোরবানির চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে। কমিটিগুলোর কাজ হচ্ছে, কোরবানির চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, ক্রেতা-বিক্রেতা পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি, সংশ্লিষ্ট স্থানে সংরক্ষিত চামড়ায় যথাসময়ে প্রয়োজনীয় লবণ প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের চামড়া সংগ্রহকারীরা বলছেন, এ কমিটি অনেকটা লোকদেখানো, তারা এ বছরও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। তাই এই কমিটি কতটা দায়িত্ব পালন করেছে, সেটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা বেড়েছে কিন্তু সাভারে চামড়া শিল্পপল্লী স্থাপিত হলেও নানা সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা সেখানে পুরোপুরি কাজ করতে পারছে না। যেকোনো মূল্যে আমাদের সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখী চামড়াশিল্পকে বাঁচাতে হবে। এ শিল্পের সাথে হাজারও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ জড়িত। সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবে। সরকারের সম্ভাবনাময় এ খাতে সুনজর দেওয়া খুবই জরুরি এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে।

 

লেখক : ব্যাংকার ও মুক্তগদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads