• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ সমবায় কার্যক্রম প্রসঙ্গে কিছু কথা

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

মো. আরাফাত রহমান

 

সমবায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যেটি একদল সদস্য তাদের সম্মিলিত কল্যাণের জন্য পরিচালনা করেন। আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী তাদের সমবায় পরিচিতি নির্দেশিকাতে সমবায়ের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে, ‘সমবায় হলো সমমনা মানুষের স্বেচ্ছাসেবামূলক একটি স্বশাসিত সংগঠন, যা নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে এবং এ লক্ষ্যে অংশীদারত্ব ভিত্তিতে গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা পরিচালনা করে।’ একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান এমনও হতে পারে. যেখানে ব্যবসাটি এর সুবিধাভোগী সকলে সমভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন অথবা তারাই এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। সমবায়ভিত্তিক ব্যবসা নিয়ে শিক্ষার যে ধারায় পড়ানো হয় তা ‘সমবায় অর্থনীতি’ নামে পরিচিত।

গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমবায়ের রয়েছে সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সর্বপ্রথম ইংল্যান্ডে সমবায় আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। ১৮২১ সালে রবার্ট ওয়েন ইংল্যান্ডের ‘নিউ লানার্ক’ নামক শহরে ও তার আশেপাশের শ্রমিকদের সংগঠিত করে সমবায় গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। সমবায়ের মাধ্যমে নিজস্ব সঞ্চয় সংগ্রহ করে শ্রমিকরা তাদের ভাগ্যোন্নয়নে ব্রতী হয়। রবার্ট ওয়েনের এ সমবায় কার্যক্রম প্রথম দুই দশকে বেশ সফলতা প্রদর্শন করে। পরে ব্যবস্থাপনার ত্রুটিজনিত কারণে চল্লিশের দশকে এসে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রবার্ট ওয়েন যেহেতু আধুনিক সমবায়ের কাঠামোগত ভিত রচনা করেছিলেন তাই তাকে ‘আধুনিক সমবায়ের জনক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সমবায় আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়। এ সময়ে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করত। কৃষিই ছিল জনগণের জীবিকার একমাত্র উপায়। ১৮৭৫ সালে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এই বিদ্রোহের মূলে ছিল কৃষি ঋণের অভাব, মহাজনি ঋণের চক্রবৃদ্ধিজনিত উচ্চ সুদের হার, কৃষকদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সালে ইন্ডিয়ান ফেমিন কমিশনের সুপারিশ মতে এবং তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন কর্তৃক গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সুপারিশ অনুসারে ১৯০৪ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ‘সমবায় ঋণদান সমিতি আইন, ১৯০৪’ জারি করেন এবং তদানীন্তন ভারত সরকার পুনরায় নতুন করে ‘সমবায় সমিতি আইন-১৯১২’ জারী করে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সমবায় আন্দোলনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন ২৬,০০০-এরও বেশি সমবায় সমিতি বিরাজমান থাকলেও এগুলোর অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ সমিতিই পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে অবসায়নে দেওয়া হয়। সরকার ও সমবায়ীদের যৌথ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে সরকার সমবায় সমিতিগুলোর ঋণ কার্যক্রম পুনরায় চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। গ্রামীণ সমিতিগুলোর পরিবর্তে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এই ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের তখন সার, বীজ কীটনাশক ডিজেল সরবরাহ করা হতো। রাসায়নিক সার ব্যবহারে সমিতিগুলো তখন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করত। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যবস্থার প্রচলনে সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৫৬ সালে ড. আখতার হামিদ খান প্রায়োগিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগে ১৯৬০ সালে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় ‘দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধতি’ চালু করা হয়। গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক সমবায় সমিতি এবং থানা পর্যায়ে কোতয়ালী থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করার মাধ্যমে ওই কর্মসূচি চালু করা হয়। ১৯৬৫ সালে ‘কুমিল্লা জেলা সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’ কুমিল্লা জেলার ২২টি থানায় চালু করা হয়। ১৯৬০ সালে সমবায় অধিদপ্তর হতে মাসিক ‘সমবায়’ এবং ইংরেজি ষাণ্মাসিক ‘কো-অপারেশন’ পত্রিকাদ্বয়ের প্রকাশনা শুরু হয়। ১৯৬০ সালে ঢাকার গ্রিন রোডে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ স্থাপিত হয়। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক মৈত্রী সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৬২ সালে প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় সমবায় নীতিমালা’ গৃহীত ও প্রচারিত হয়।

১৯৭১ সালে ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’ চালু করার মাধ্যমে কুমিল্লাস্থ দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধতির কার্যক্রম প্রদেশব্যাপী ছড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির সদর দপ্তর ঢাকায় স্থাপন করে একজন নির্বাহী পরিচালকের অধীনে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। স্বাধীনতার পর সমবায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সমবায়কে মালিকানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমবায়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশের প্রত্যেক ইউনিয়নে ইউনিয়নভিত্তিক বহুমুখী সমবায় সমিতির মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে সহজে এবং সুলভ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্য এবং কৃষি উপকরণ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন।

তা ছাড়া দেশের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে কৃষি সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়েছিল। অন্যদিকে, সমবায় আন্দোলনে দ্বি-মুখী ধারা প্রবাহিত হয়। একদিকে সমবায় বিভাগ পরিচালিত কার্যক্রম কৃষি ক্ষেত্র ছাড়াও অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে। যেমন, মৎস্য চাষ, ইক্ষু চাষ, তাঁত শিল্প, হস্ত শিল্প, দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদির নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। অপরদিকে আইআরডিপি’র দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায় কার্যক্রম প্রধানত কৃষি ক্ষেত্রে জোরেসোরে চালু হয়। আইআরডিপি তার মূল প্রকল্পের অধীনে গ্রাম পর্যায়ে কৃষক সমবায় সমিতি এবং থানা পর্যায়ে থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন গঠনের মাধ্যমে পল্লীর জনগণকে সংগঠিত করতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুধের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সমবায়ের ভিত্তিতে দুগ্ধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লি. (মিল্কভিটা) প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭৫ সালে সমবায় বিভাগ যানবাহন ও পরিবহন সমবায় সমিতি গঠনের দিকে মনোনিবেশ করে। ফলে বাংলাদেশ গণপরিবহন চালক সমবায় সমিতি ও পরে বাংলাদেশ অটো রিকশা চালক সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে। আইআরডিপি মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে মহিলা সমবায় সমিতি গঠন শুরু করে। ১৯৮২ সালে সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আইআরডিপির স্থলে ‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করে তাকে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা হয়। একই সালে সমবায় বিভাগ ‘বাংলাদেশ ট্রাকচালক সমবায় ফেডারেশন’ গঠন করে পরিবহন সমবায়ের কার্যক্রম আরো জোরদার করে। ১৯৮৩ সালে সমবায় বিভাগের অধীনে ‘বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ হাউজিং ফেডারেশন’ গঠনের মাধ্যমে হাউজিং সমবায় সমিতি গঠনের চেষ্টা চালায়।

১৯৮৩ সালে দেশের ১৩টি বৃহত্তর জেলায় ‘পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-২’-এর কার্যক্রম বিআরডিবি’র মাধ্যমে চালু করা হয়। এর একটি অংশ ‘অডিট ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পটি সমবায় বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিআরডিবি পরিচালিত সমিতিগুলোর অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য ওই প্রকল্পের অধীনে বেশকিছু অডিট কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিআরডিবি কর্তৃক ‘পল্লী দরিদ্র কর্মসূচি’ চালু করা হয়। এর আওতায় গ্রামপর্যায়ে প্রথমে বিত্তহীন সমবায় সমিতি এবং পরে মহিলা বিত্তহীন সমবায় সমিতি গঠনের কাজ শুরু করা হয়।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪০ সালের পুরাতন বঙ্গীয় সমবায় আইন বাতিল করে ‘সমবায় সমিতি অধ্যাদেশ-১৯৮৪’ জারি করে যা ১৪ জানুয়ারি ১৯৮৫ তারিখে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। একই সালে সরকার সমবায় বিভাগের চাকরি বিসিএস ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে ২০ জানুয়ারি ‘সমবায় সমিতি নিয়মাবলী-১৯৮৭’ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জারি করা হয়। এতে নির্বাচন সংক্রান্ত সমবায়ের নতুন বিধিমালাসহ অনেক বিধি প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়।

১৯৮৯ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সমবায় নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়। সমবায় বিভাগের আওতাধীন আটটি আঞ্চলিক সমবায় ইনস্টিটিউট উন্নয়ন প্রকল্পটি ওই বছরই জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো বাংলায় সমবায় আইন জারি করা হয়। ২০০২ সালে ২০০১ সালের সমবায় আইনের কতিপয় ধারা সংশোধন করে সংশোধিত আইন, জারি করা হয়। সমবায় সমিতি আইন, ২০০১ ও সংশোধিত আইন ২০০২-এর সমর্থনে ২০০৪ সালে সমবায় সমিতি বিধিমালা, ২০০৪ জারি করা হয়। দারিদ্র্যমুক্ত আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ায় সমবায় উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান এবং গণমুখী সমবায় আন্দোলনের দিকনির্দেশনার প্রয়োজনে ১৯৮৯ সালে প্রণীত সমবায় নীতিমালাকে যুগোপযোগী করে ‘জাতীয় সমবায় নীতিমালা-২০১২ প্রণয়ন করা হয়। ২০১৩ সালে সমবায় আইনকে অধিকতর সংশোধন করে সংশোধিত সমবায় আইন, ২০১৩ জারি করা হয়।

এ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সমবায় আন্দোলন অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি ও ভোগ্য পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, মৎস্য চাষ, ইক্ষু চাষ, দুগ্ধ উৎপাদন, প্রকিয়াজাতকরণ এবং বিপণন, তাঁতশিল্প, হস্তশিল্প, মৃতশিল্প, চামড়া শিল্প, যানবাহন, আবাসন, মৌচাষসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলো বিচরণ করছে। সমবায়গুলো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য এখন বিদেশেও রপ্তানি করছে। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে সংগঠিত এসব সমিতির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় পৌনে দুই লক্ষ। দেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ এসব সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করে সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করেছে। সমবায় আন্দোলন দেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

 

লেখক : সহকারি কর্মকর্তা, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

arafatrahman373@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads