• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বৈশ্বিক জোটনীতি এবং কৌশলগত নিরাপত্তা

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০২১

জো বাইডেনের আগের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি ছিল আমেরিকা ফার্স্ট। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে সব প্রধানই একমত। সেই কৌশলেই অগ্রসরমাণ বর্তমান সরকার। সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং অন্যান্য দিক মিলিয়ে আমেরিকা বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে এখনো এককভাবেই প্রভাবশালী। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের প্রবণতা এবং এই প্রবণতা থেকেই এক দেশ অন্য পরাশক্তিকে মোকাবিলায় জোটবদ্ধ অবস্থান গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের  সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলে আসছে চীনের। দ্বন্দ্ব মূলত বিশ্বে আধিপত্য ধরে রাখার এবং বিস্তার করার। যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই পৃথিবীতে প্রায় একক আধিপত্য ধরে রেখেছে এবং চীন সেই পথে বর্তমান সময়ে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। চীনের বৈশ্বিক ক্ষমতায়নের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। অনেকেই বিষয়টিকে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা বলছেন। স্নায়ুযুদ্ধ যে বিশ্বের জন্য ক্ষতিকর তা নিয়ে সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছে। গঠিত হচ্ছে জোট। স্বাক্ষরিত হচ্ছে চুক্তি। সম্প্রতি এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা বৈশ্বিক রাজনীতিতে উত্তেজনা ছড়িয়েছে।

বিশ্ব রাজনীতি এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের মালিক হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সঙ্গে নতুন নিরাপত্তা চুক্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার। পারমাণবিক সাবমেরিন বর্তমান বিশ্বের সমরাস্ত্রে একটি অতি আধুনিক সংযোজন। মাত্র কয়েকটি দেশের হাতে এই অস্ত্রটি রয়েছে। দেশগুলো হলো, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ভারত। এখন নতুন করে পেতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। এটি হাতে পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনীর সক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যাবে। ফ্রান্সকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের  সঙ্গে পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার চুক্তিতে ফ্রান্স অসন্তুষ্ট হলেও দেশগুলোও একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্টকে পাশ কাটানো ফ্রান্সের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের আশেপাশে যেখানে চীনের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে বলে অস্ট্রেলিয়া মনে করছে সেখানে নজরদারি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।

ডিজেলচালিত সাবমেরিনের চেয়ে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন এতটাই অত্যাধুনিক যে এটি শত্রুপক্ষের চোখ অনায়াসেই ফাঁকি দিয়ে গভীর সমুদ্রের নিচে ডুবে থাকতে এবং চলাচল করতে সক্ষম। এই চুক্তির ফলে ফ্রান্স নাখোশ হয়েছে। এর কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের  সঙ্গে চুক্তির ফলে ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার করা পাঁচ বছর ১২টি ডিজেলচালিত সাবমেরিন কেনার প্রায় চার হাজার কোটি ডলারের চুক্তি বাতিল করেছে। চুক্তিটি হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। স্বভাবতই অস্ট্রেলিয়ার এই গোপন চুক্তিতে ফ্রান্স খুশি হতে পারেনি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ন্যাটো মিত্র ফ্রান্স। এটাকে বাইডেন প্রশাসন কিভাবে সামাল দেবেন তাই দেখার বিষয়। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে নিজের সুরক্ষায় ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে কোনো দেশই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। ফলে অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের এই পরমাণু সাবমেরিন চুক্তিটির পেছনেও চীনকে ঠেকানোর একটি কৌশল রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দক্ষিণ চীন সাগর এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে ক্রমাগতভাবে চীন শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার জন্য এটি একটি অনেক বড় সিদ্ধান্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই দুয়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া স্পষ্টত কোনো অবস্থান এতদিন নেয়নি; কিন্তু কিছু বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে চীনই এখন যুক্তরাষ্ট্রের এবং তার মিত্র দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ। এই প্রতিযোগিতায় এখন অস্ট্রেলিয়াও যুক্ত হলো। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা করে। অন্য শক্তিশালী দেশের  সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। দুর্বল বা সবল কোনো দেশ এ ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রয়োজনে মিত্রদেশের  সঙ্গে জোটভুক্ত হয়েও নিজেকে সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত। অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের এই সাবমেরিন ক্রয়ের চুক্তির আগে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া এই তিন দেশের একটি জোট ’অকাস’ গঠিত হয়। বলা হয়, এই জোট গঠনের অন্যতম লক্ষ্য হলো দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানো। অকাস চুক্তির আওতায় থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম টেকনোলজি ও সাইবারের মতো বিষয়গুলো। এই ঘটনায় ফ্রান্স এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে তার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের  সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তিও বাতিল করেছে ফ্রান্স। ফান্সের ক্ষোভ প্রশমনে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় বাইডেনের ফোনের পর ফ্রান্স তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়েছে। এই ঘটনা একটি বিষয়কে ইঙ্গিত করে যে, চীনকে প্রধান প্রতিযোগী মনে করে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকানো ও তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে একটু নতুন কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকেও পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।

অকাসে থাকা দেশত্রয়ী ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সামরিক উপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। এই জোট পূর্বের মিত্রতাকে আরো শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে। এই জোট গঠনের আগে আরও একটি জোট গঠিত হয়েছে যার নাম ‘কোয়াড’। কোয়াডের সদস্য দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান। কোয়াডের সূচনা থেকেই জোটটিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে চীনের বিরোধী জোট হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কারণ কোয়াডের সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সুখকর নয়। বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি দুই দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী। কোয়াড চীনকে মোকাবিলার কৌশল নিয়ে গঠিত হয়েছে। কোয়াডের নেতারা জোটের সশরীরে প্রথম বৈঠকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের জন্য একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতবদ্ধ।

পৃথিবীজুড়ে কাজ করছে প্রভাব বিস্তারের কৌশল এবং টিকে থাকা। টিকে থাকার স্বার্থে কৌশলগত অবস্থানে থেকে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রত্যাশায় জোট গঠিত হচ্ছে। এই জোট কেবল নিজেদের সুরক্ষার কাজই করছে না পাশাপাশি তুলনামুলক নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা দেশের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে এবং সেই দেশের প্রভাব বিস্তারের গতি শ্লথ করছে। আজ সারা বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত রূপ দেখা দিয়েছে। কারণ অস্ত্রই ক্ষমতার উৎস বলে স্বীকৃত এবং পাওয়ার পলিটিক্সের প্রধান ধারক। অস্ত্র প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্যই হলো স্থল, আকাশ ও নৌপথে নিজের দেশকে সবার চেয়ে এগিয়ে রাখা। নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করা। অন্য দেশের ওপর খবরদারি করা। এশিয়ায় শক্তিমত্তা বাড়িয়ে চলেছে চীন ও ভারত। এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি মোকাবেলায় শিজিনপিংয়ের মেয়াদকালের শুরু থেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে শুরু করে চীন।

প্রতিটি দেশই একটি বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিজেকে গুরুত্ববহ করতে কৌশল অবলম্বন করছে। সমরাস্ত্র এবং বাণিজ্য উভয় ক্ষেত্রেই শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে। বাণিজ্যিক দিক থেকেও চীন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেছে। সারা বিশ্বে চীনা পণ্য ও প্রযুক্তি পৌছে গেছে। গত বছরের নভেম্বরে ১৪টি দেশের সঙ্গে মিলে চীন একটি মুক্তবাণিজ্য জোট রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপও (আরসিইপি) করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ বাণিজ্য জোট আরসিইপিতে চীন ছাড়াও আছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা জোট গঠনের ঘোষণা দেওয়ার পরদিন সিপিটিপিপি বা কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ এগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপে বেইজিংয়ের যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা জানা যায়। ২০১৮ সালে সিপিটিপিপিতে ১১টি দেশ স্বাক্ষর করে। বৈশ্বিক রাজনীতি এখন ক্ষমতা নির্ভর এবং জোট ও কৌশলী। তবে বিশ্ব চায় এসব জোটনীতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। হুমকি মোকাবিলায়ও জোট গঠন করা হোক, তবে সেটা যেন সত্যিকারের শান্তি-শৃঙ্খলা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। কেউ কারও জন্য হুমকি নয় বরং বন্ধুভাবাপন্ন হবে—এমন প্রত্যাশাই বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে।

 

লেখক : সাংবাদিক

sopnil.roy@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads