• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

পথশিশুদের কঠিন জীবন

  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০২১

শাহীন চৌধুরী ডলি

 

একটি পরিবারে শিশু বা নবজাতকের আগমন পরিবারে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়। পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজনের সাথে সাথে নবজাতকের আগমন পাড়া-প্রতিবেশীদেরও আনন্দিত করে। কিছু নির্দিষ্ট পারিবারিক আচরণ জন্মের পর থেকে শুরু করে শৈশব পেরোনোর আগ পর্যন্ত শিশুর ওপর নানা প্রভাব ফেলে। সব শিশুর ভাগ্য সমান ভালো হয় না। পৃথিবীতে যত পথশিশু রয়েছে তাদের সবার ক্ষেত্রে কিছু কারণ আছে। প্রতিটি পথশিশুর নিজস্ব একটা কাহিনী রয়েছে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। যদিও অন্যান্য কারণগুলো সমান তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে হতে পারে— পিতামাতার মৃত্যু, পিতামাতার অবহেলা, এবং অন্যান্য সামাজিক কারণ, যেমন— পারিবারিক বা সামাজিক সহিংসতা এবং শিশুদের ওপর নির্যাতন।

এদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই বস্তিতে বসবাস করায় বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষার আওতায় সবাই সুবিধা পায় না। বহু পরিবার শিশুদের সঠিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। শিশুরাও তাদের অধিকার, বিকাশ ও সুরক্ষা নিয়ে কোনো কথা বলতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর জন্য যেসব সেবা রয়েছে সে বিষয়গুলো সম্পর্কেও তারা জানে না। যেসব শিশুর জন্য রাস্তা বসবাসের স্থান অথবা জীবিকার উপায় হয়ে গেছে তারাই পথশিশু। ওরা আর সব সাধারণ শিশুর মতন নয়। এদের পারিবারিক বন্ধন নেই। ভাগ্যের ফেরে এইসব শিশুদের কিছুই পাওয়া হয় না। অনেক শিশুরা পথেঘাটে অমানবিক জীবনযাপন করছে। তারা থাকে ফুটপাত, পার্ক, রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, ফুট ওভারব্রিজ অথবা খোলা কোন জায়গায়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের পথে পথে ছড়িয়ে আছে বিপুল সংখ্যক পথশিশু। তবে বাংলাদেশের পথশিশুদের বড় অংশই রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশে বহুসংখ্যক পথশিশু রয়েছে, তবে এর সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক জরিপ বলছে— সারা বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। সে জরিপের বিরোধিতা করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর, যদিও পথশিশুদের জীবনমান উন্নয়নে তাদেরই জরিপ করার কথা।

উন্নত দেশগুলোতে প্রত্যেক শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র কোনো না কোনোভাবে পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রযন্ত্র এদের সম্পর্কে সচেতন নয়। এদের দেখার কেউ নেই। অবহেলা, অনাদরে খেয়ে না খেয়ে এদের দিন কাটে। প্রতি বছর ২ অক্টোবর আমাদের দেশে পালিত হয় ‘জাতীয় পথশিশু দিবস’। দিনটি পালন উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এসব কর্মসূচি যারা পালন করেন, হয়তো তারাও একবার ভেবে দেখেন না, কেন দিবসটি পালন করছেন। এই বিশেষ দিবসটি পালনের সঙ্গে লুকিয়ে থাকে লজ্জা। শিশুদের এই অবস্থার জন্য দায়ী আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো। সবচেয়ে বড় কথা, যাদের জন্য এই দিবসটি পালিত হয় সেই পথশিশুদের এই দিবসের মধ্য দিয়ে প্রাপ্তির কিছু থাকে না।

২০০৫ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক গবেষণায় বলা হয়, দেশের শতকরা ৪১ ভাগ পথশিশুর ঘুমানোর বিছানা নেই; ৪০ শতাংশ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না; ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করে; ৮৪ শতাংশ শিশুর শীতবস্ত্র নেই; ৫৪ শতাংশ শিশুর অসুস্থতায় দেখার কেউ নেই; ৭৫ শতাংশ পথশিশু অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাতে পারে না; ৮০ শতাংশ শিশু জীবন টিকিয়ে রাখতে কাজ করে; ২০ শতাংশ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়; এবং ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু সার্বিকভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়।

ক্ষুধার জ্বালা, একাকিত্বের কষ্ট বা সঙ্গদোষে তারা নানা ধরনের মাদক গ্রহণ করে। ড্যান্ডি এমন এক মাদক যা অসংখ্য পথশিশু সেবন করে থাকে। ড্যান্ডি সেবন করা পথশিশুদের ভাষ্যমতে, ‘ক্ষুধা লাগে। ড্যান্ডি খাইলে ঝিমুনি আসে, ঘুম আসে। তখন ক্ষুধার কথা মনে থাকে না।’ বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকাসক্ত। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক গ্রহণ করে। পথশিশুরা সাধারণত ড্যান্ডি, গাঁজা, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে এবং পেট্রোল শুঁকে নেশা করে।

পথশিশুরা মাদক বিক্রি, যৌনকর্ম, রাজনৈতিক শোডাউন, ভাঙচুর, ছিনতাইসহ নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। নিজের অজান্তে খেয়ালখুশি মতো জীবন পরিচালনা করতে গিয়ে বেশিরভাগ পথশিশুই এমন বিপথগামী হয়ে যায়। এই অবস্থায় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে এসব শিশুদের ব্যবহার করার মতো অমানবিক কাজটি করে স্বার্থান্বেষী মহল। অনেক সময় পথশিশুরা নিজ থেকে বিপথে চলে আসে। জঘন্য ব্যাপার হচ্ছে মেয়ে পথশিশুদের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মেয়ে পথশিশুদের যৌনকর্মে বাধ্য করার ঘটনা ঘটে। বেসরকারি সংগঠন সাজেদা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে তারা অন্তত ১৫ হাজার পথশিশুর সেবা দিয়েছে, যারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে এমন শত শত কিশোরীকে তারা সেবা দিয়েছে।       

ভিক্ষা ও অর্থ উপার্জনের জন্য পথশিশুদের শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী করা হয়। পুলিশ দপ্তরের সূত্র মতে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। মোবাইল ছিনতাইয়ের মতন ঘটনাগুলোতে ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী অনেক পথশিশু জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অনেক সময় এরা সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউনে পিকেটিংয়ে এদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

অন্যের ফেলে দেয়া খাবারেই পথশিশুদের ক্ষুধা নিবারণ হয়। ক্ষুধায় কাতর হয়ে ডাস্টবিন থেকেও তারা খাবার কুড়িয়ে খায়। কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অথবা অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পথশিশুদের সাহায্য করে থাকে। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ গৃহহীন পথশিশু ফুটপাতে, ফ্লাইওভারের নিচে, রেল বা বাসস্টেশনে, সরু গলিতে, রাস্তার কিনারায় ঘুমায়। তাদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানীয় এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই বলে তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব দুর্বল।

করোনায় সাধারণ মানুষের আয় রোজগার কমে গেছে। অনেকের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক কারণেই আগের মতন সাহায্য সহযোগিতা বা দান পাচ্ছে না পথশিশুরা। করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের আয়ের ন্যূনতম উপায়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পথে-ঘাটে অবস্থান, যেখানে সেখানে রাত্রিযাপন ও দলবেধে খাবার সংগ্রহের কারণে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকিতে হয়েছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা। তাদের সাহায্য দরকার, খাবার দরকার, থাকার নিরাপদ জায়গা দরকার। কোভিড-১৯ নিয়ে সরকারের যেসব উদ্যোগ আছে সেগুলো থেকে ঢাকা শহরসহ দেশের সর্বত্র পথশিশুদের সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকতে হচ্ছে। যে কোনো দুর্যোগে যখন সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয় তখন যাদের ঘর নেই তারা কোথায় থাকবে, কি খাবে? আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী যে-সব শিশুর পারিবারিক পরিবেশ তার স্বার্থরক্ষায় উপযুক্ত নয় সে-সব শিশু রাষ্ট্র থেকে বিশেষ সুরক্ষা এবং সহায়তা পাওয়ার অধিকার রাখে। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা পথশিশুদের শারীরিক, মানসিক বা নৈতিক বিকাশ, একাডেমিক শিক্ষার ব্যবস্থা, ভরণ-পোষণ ও ভবিষ্যতে তাদের স্বাবলম্বী করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সুরক্ষা ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার সক্ষমতা আমাদের সরকারের আছে। শিশুদের কল্যাণে নেই কোনো নীতিমালা। সরকার ঘোষিত ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে এখনই পথশিশুদের কল্যাণে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করা প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা যায় না। অনেক সময় থোক বরাদ্দের অপচয় হয়। বরাদ্দকৃত অর্থের চুরি, লুটপাট চলে। অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ জবাবদিহিতা না থাকায় থোক বরাদ্দের বড় অংশ অপচয় হয়। তবে সমাজের নানাভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ বড় ভূমিকা রাখে। সুষ্ঠু জবাবদিহিতার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য করোনাকালে সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

একটি দেশের সরকারের দায়িত্ব সে দেশের পথশিশুদের আবাস, লেখাপড়া, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা। সরকার উদ্যোগ নিলেই তা সম্ভব। একটা সমন্বিত নীতিমালা থাকলে পথশিশুরা এর সুফল পেতো। পথশিশুদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এই কাজে সরকারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এনজিওসহ বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মাবলী শিশুদের শেখাতে হবে। তাদের কাউন্সেলিং করে মনোবল বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সুরক্ষার অভয় দান করতে হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ পথশিশুদের সংখ্যা যত বাড়ছে ততই নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। জনসংখ্যার বড় একটা অংশ সুবিধাবঞ্চিত শিশু। তবে কিছুটা আশার কথা হলো অনেক পথশিশুদের স্থান হয়েছে সরকারি শিশুনিবাসে। ভালোবাসার পরশ পেয়ে তারা অনেকটা শৃঙ্খলাপরায়ণ জীবনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। সমাজকে সুশৃঙ্খল করতে হলে পথশিশুদের নিরাপত্তা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাই সব শিশুর স্বার্থ হোক সর্বোত্তম। পথশিশুদের প্রাপ্য অধিকার দিয়ে সঠিক নিয়মে বড় করে তুলতে পারলে তাতে জাতি উপকৃত হবে। আমরা আশা করি, দেশের বিবেকবান মানুষ ও সরকার পথশিশুদের কঠিন জীবন থেকে মুক্তি দিতে তাদের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিবেন। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, একদিন বাংলাদেশ পথশিশুমুক্ত হবে।

 

লেখক : মুক্তগদ্য লেখক

shaheen.babu1971@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads