• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

শরণার্থী সংকট

একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সংকট  

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০২১

পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকার। আশ্রয়হীন মানুষকে পৃথিবীতে বাস্তুচ্যুত বলা হয়। আর বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিলে তাকে শরণার্থী বলে। মূলত শরণার্থী হলো একজন মানুষ যার নিজের আশ্রয় রয়েছে, দেশ রয়েছে, সেখানে থাকার অধিকার রয়েছে কিন্তু তাকে আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র যেতে হয় এবং সেখানে তিনি অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কখনো সেই বসবাস বহু দিনের দীর্ঘ হয় আবার ভাগ্য ভালো হলে অল্প দিনেই দুর্ভাগ্যের শেষ হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে বর্তমান পৃথিবীতে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও তাদের আশ্রয় পাবার পূর্ণ অধিকার রয়েছে বাকি সবার মতো তবুও তাদের সেই অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিশ্বজুড়েই আশ্রয়হীন শরণার্থী মানুষের ভিড়। মাথার ওপর বিশাল আকাশ সব মানুষের ছাদ হয়ে থাকলেও সবার কপালে আশ্রয় জুটছে না। যে নিশ্চিত আশ্রয়ে তারা জন্মগ্রহণ করছে, সেই আশ্রয় একসময় ছাড়তে হচ্ছে। আশ্রিত, বাস্তুচ্যুত, শরণার্থী অথবা উদ্বাস্তু নামে তাদের আশ্রয় নিতে হচ্ছে অন্য কোনো দেশে। মানুষের এই পরিণতির জন্য মূলত মানুষই দায়ি।

সিরিয়া ও ভেনিজুয়েলার পর সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে আফগানিস্তানে। গত চার দশকে দেশটির প্রায় ৬০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের বেশিরভাগ পার্শ্ববর্তী ইরান, পাকিস্তান বা তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের পট পরিবর্তনে নতুন করে শরণার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো একেবারেই অপর্যাপ্ত এবং ক্রমাগত অবহেলিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এসব শরণার্থী শিবিরে জন্ম নেওয়া শিশুরা তাদের জন্ম থেকেই শরণার্থী হিসেবে বড় হয়ে উঠছে। শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। সেসব শিশুরা এমন একটি পরিবেশে বড় হয়ে উঠছে যা একটি শিশুর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রতিকূল। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে যেখানে তাকে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। নিজের আশ্রয় ছেড়ে তারা এখন শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। বিপুল সংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশ মানবিক কারণেই আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এদের ভবিষ্যৎ কী বা কবে নিজ ঘরে ফিরতে পারবে সে বিষয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি।

বিশ্বের ধনী দেশগুলো বৈশ্বিক শরণার্থী সমস্যার আপাত সমাধান হিসেবে আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে ঠিক কিন্তু একটি প্রত্যাশিত সমাধান যা তাদের বাস্তুচ্যুত বা শরণার্থী অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে সে বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। একটি প্রত্যাশিত মানবিক বিশ্ব উপহার দিতে বিশ্ব নেতারা স্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বজুড়েই বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন— নদী ভাঙন, বন্যা, খরা এবং গৃহযুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করা, খাদ্য সংকট, পানি সংকট ইত্যাদি নানামুখী কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাছাড়া পৃথিবীজুড়েই আজ হানাহানি, হামলা, শক্তিমত্তা প্রদর্শন, নিপীড়ন এসব ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। আফ্রিকার চাদ বেসিন অঞ্চলের দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে বেছে নিতে হয়েছে শরণার্থীর জীবন। আফ্রিকার লেক চাদ বেসিন অঞ্চল থেকে প্রায় ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে অপেক্ষার দিন গুনছে। আফ্রিকার অন্যান্য দেশ ইরিত্রিয়া, শাদ, ক্যামেরুন, নাইজার ও নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশেও রয়েছে শরণার্থী সমস্যা। আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার পরিস্থিতি তো পৃথিবীর অন্যতম বড় সংকটের দেশ। বহু বছরের চলা অবস্থানে দারিদ্র্য, ক্ষুধা প্রভৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী দেশে। শরণার্থী হয়েও তারা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। লাখ লাখ মানুষের এ পরিস্থিতিতে চরম মানবিক সংকটে চলছে। এসব শরণার্থী মূলত খাদ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। আরব বসন্তের দেশ লিবিয়ায় রয়েছে শরণার্থী সমস্যা। ২০১১ সালে লিবিয়ায় আরব বসন্তের মধ্যে দিয়ে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। দেশটির অভ্যন্তরে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পরে। জানা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ২ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পরে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট ২০২১ এর সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে উদ্বাস্তু পাঁচ কোটি মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে গত বছরে বিশ্বের ১৪৯টি দেশ ও ভূখণ্ডে নতুন করে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দাড়িয়েছে পাঁচ কোটি ৫০ লাখ।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো দেশের অভ্যন্তরে এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয়হীন মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণে যারা আশ্রয়হীন হচ্ছে তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে। অন্যদিকে যারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে আশ্রয়হীন হচ্ছে তাদের দীর্ঘদিন আশ্রয়হীন অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হচ্ছে। তাদের সমস্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে চলে যাচ্ছে যার সুরাহা সহসাই হচ্ছে না। প্রতি বছর যদি উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে পৃথিবী এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে যেতে পারে। কারণ এই মানুষগুলোর হাতে কাজ থাকে না, তাদের মেধার মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না, শিশুরা বড় হয়ে ওঠে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশে এবং নারীদের মূলত কিছুই করার থাকে না। তারা পুরোপুরিভাবে নির্ভর করে অন্যের সাহায্যের। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের শ্রম-মেধা বাদ দিয়ে কোনোদিনই পৃথিবী শান্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১৯ সালের শেষে সারা পৃথিবীতে ৭ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় ছিল। আরও বলা হয় যে, এর আগে ইতিহাসে এত মানুষ কখনো গৃহহীন ছিলেন না। তার আগের বছর ২০১৮ সালে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮ লাখ। সে হিসেবে এক বছরে শরণার্থী বেড়েছে ৮৭ লাখ। মূলত দুটি কারণে প্রকাশিত রিপোর্টে বিশ্বের সব দেশকে শরণাথী এবং সংঘাত, নিপীড়ন বা অন্য হুমকির কারণে উদ্বাস্তুদের নিরাপদ আশ্রয় ফিরে পেতে সাহায্য করার জন্য আহবান জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯০ এর দশকে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ মানুষ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নিজ দেশে ফিরতে পারতেন। চলতি দশকে এ সংখ্যা কমে ৩ লাখ ৯০ হাজারে পৌঁছেছে। বর্তমান পৃথিবীর একটি অন্যতম বড় সমস্যা হলো শরণার্থী সংকট। এতদিনেও শরণার্থী নিয়ে তেমন কোনো আশাব্যঞ্জক খবর আসেনি যা তাদের স্থায়ীভাবে ফিরিয়ে দিতে পারে। এভাবে শরণার্থী বৃদ্ধি পেতে থাকলে তা ভবিষ্যতে বড় সংকট তৈরি করবে।

পৃথিবী সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই মানুষ একটি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছে। একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়েও দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অন্য রাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো সত্যিই দুর্ভাগা। এরা তখন রাষ্ট্রহীন নাগরিক! মানুষের আশ্রয় নিরাপদ করতে বা নিশ্চিত করতে বিশ্ব শক্তিগুলো শান্তি খুঁজতে গিয়ে পৃথিবী অশান্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং প্রয়োগ, অস্ত্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয় (যার পেছনেও মানুষের দায় রয়েছে) প্রভৃতি কারণে মানুষের আজকের পরিণতি। যার দায় নিতে হচ্ছে কিছু মানুষকে। ভাবতে হবে ক্রমেই এই মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব মানুষ অবশ্য কোনোভাবেই এসব পরিস্থিতির জন্য দায় নিতে রাজি নয়। এরা হলো পরিস্থিতির শিকার। বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হওয়া এসব মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে ছুটছে। এই বিরূপ পরিস্থিতি তৈরিতে মানুষের হাত রয়েছে। যেখানে তারা বড় হয়েছিল, স্বপ্নের আবাস গড়ে তুলেছিল তারা সেখান থেকে আশ্রয়হীন হচ্ছে। এসব আশ্রয়হীন মানুষ ছুটছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক শহর থেকে অন্য শহরে। অনেক মানুষ তার জীবনের বাকি দিনগুলো এভাবে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হিসেবেই কাটিয়ে দিচ্ছে। তারা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব নেতাদের দায়িত্ব হলো এসব মানুষকে তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দিয়ে অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

 

লেখক : সাংবাদিক

sopnil.roy@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads