• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

প্যারিস চুক্তি

জলবায়ু পরিবর্তিত বিশ্ব রক্ষায় জরুরি

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০২১

জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়া পাল্টে যাবার কথা অনেকদিন থেকেই আলোচনায়। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছিলেন। ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাবার কথাও অনেক পুরোনো। কিন্তু সেই পুরোনো কথার গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আর দিলেও তা যে যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, এমন বলার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা মানুষ শুনেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তহবিল সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন ফোরামের নানা আয়োজনে উত্তেজক কথাবার্তা বলে হাততালি নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। একে অন্যকে দোষারোপের সংস্কৃতিও রয়েছে। আর ধনী রাষ্ট্রগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করছে, তার বিপরীতে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো রীতিমতো অসহায়। ফলে একদিকে দোষারেপের সংস্কৃতি, দরিদ্র দেশগুলোর আহাজারি, পৃথিবীব্যাপী সচেতন মানুষদের আর্তনাদ অন্যদিকে বায়ুমণ্ডলে অবিচ্ছিন্নভাবে কার্বন নিঃসরণ চলতে থাকে। ফলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাও ফলতে শুরু করেছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে, হিমালয়ের বরফ গলছে। সেই পানি ধেয়ে আসছে সমুদ্রে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আর ওজোনস্তরের ফুটো বাড়তে থাকারও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশ্বের তাপমাত্রার যে পরিবর্তন তাও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। পেছনের একশ বছরের তাপমাত্রা মিলিয়ে দেখে, বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠার প্রমাণও হাতেনাতে ফলতে শুরু করেছে।

মাঝে কয়েকদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল পরিবেশবাদীরা। করোনা মহামারি শুরুর পর, সবাই যখন জীবন বাঁচাতে ঘরে ঢুকে পড়ে, তখন প্রকৃতিও প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে। কল-কারখানা বন্ধ, গাড়ির চাকা ঘুরছে না, পেট্রোল, ডিজেল পুড়ছে না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ইটভাটাগুলোতে কাঠ পুড়ছে না, বৃক্ষনিধন কমে যাওয়ায় পরিবেশও নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করে। বায়ুদূষণের শীর্ষে থাকা আমাদের রাজধানীতেও গত কয়েক মাসে দূষণের পরিমাণ কমে আসে। সূচকেও আমাদের উন্নতি ঘটে। এ তো গেল অদৃশ্য এবং বায়বীয় কথাবার্তা। পরিবেশের দৃশ্যমান উন্নতিও মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আমাদের যে সৈকতে শেষ কবে ডলফিন দেখা গেছে, তা কেউ মনেই করতে পারে না। সেখানেও করোনাকালে ঝাঁকে ঝাঁকে ডলফিন এসে হাজির হয়। তাদের উপস্থিতিতে প্রাণ ফিরে পায় সমুদ্রসৈকত। সাগরপাড়ে উঠে আসে সামুদ্রিক কচ্ছপ। সংবাদমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদন মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। প্রকৃতির সজীবতায় মানুষও হাঁপ ছাড়ে। কিন্তু এ দৃশ্য ছিল সাময়িক। করোনা মহামারির মাঝেই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা স্পষ্ট দেখতে শুরু করি। করোনার মাঝেই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই দেখা দেয় বন্যা। উজানের নেমে আসা ঢলে দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি জেলা তলিয়ে যায়। আশ্রয়হীন হয় অসংখ্য মানুষ। বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় থাকলেও, এবারের মতো দীর্ঘমেয়াদি বন্যা বিরল। কয়েক দফা বন্যায় দেশের উত্তরের অনেক জেলাই এখনো পানিবন্দি। সংবাদমাধ্যম বন্যার খবর জানিয়ে প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে নদীর পানি কমার লক্ষণ নেই। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে বেশ কয়েকটি ফেরিঘাটও। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে আমাদের ওপর পড়তে শুরু করেছে, তা স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর যে তালিকা বহু পূর্ব থেকেই অনুমিত, আমরা সেই তালিকাভুক্ত দেশ। ফলে আমাদের ভয় আরো বেশি। আমাদের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তাও অনেক বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবীর কোনো দেশই মুক্ত থাকবে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সকল দেশকেই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে এবারে জাতিসংঘের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনের আগে জলবায়ুু সংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের একটি ভার্চুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় এক ভিডিওবার্তার মাধ্যমে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের কাছে পাঁচটি প্রস্তাব দেন। পৃথিবীকে রক্ষায় দেওয়া পাঁচটি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে এবং নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অবশ্যই জোরালো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উৎসাহিত করার পরামর্শ দেব।’ দ্বিতীয় প্রস্তাবনায় তিনি বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং সব প্যারিস প্রবিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবনায় বলেন, দুর্বল দেশগুলোকে প্রতিশ্রুত তহবিল সরবরাহ করতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দূষণকারী দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রশমন ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের এনডিসি (জাতীয় নির্ধারিত অবদান) বাড়াতে হবে। এবং পঞ্চম প্রস্তাবনায় বলেন, জলবায়ু শরণার্থীদের পুনর্বাসন একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ আজ সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত, বাংলাদেশ তার অন্যতম। প্রতিবছরই আমাদের লাখ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া। মেরু অঞ্চলের বরফ গলায় সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে আমাদের ভূখ্লের অনেক অংশই তলিয়ে যাবে। নষ্ট হয়ে যাবে আমাদের জীববৈচিত্র্য। এই যে শঙ্কা প্রতিনিয়ত আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি, সেই শঙ্কা থেকেই প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীকে রক্ষায় তার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। ধনী দেশগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও যদি তার প্রস্তাবনা অনুসরণ করে যথাযথ দায়িত্ব পালন করে থাকে, তাহলে পৃথিবীর বিপদমুক্ত হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। 

জলবায়ু পরিবর্তন আজকের পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় সংকট। এই সংকটের ভয়াবহতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, দেশে দেশে উপলব্ধি হতে শুরু করেছে। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে প্রকৃতি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ঋতুবৈচিত্র্য। প্রকৃতি তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও পরিবর্তন ঘটছে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। বন্যা অনেকস্থানেই স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। বজ্রপাতের পরিমাণ বেড়েছে, বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর হারও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী দাবানল, আমাজনের দাবানলসহ অনেক দেশেই তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে মাত্রাতিরিক্ত গরমে কাহিল হয়ে পড়েছে মানুষ।

যা থেকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীরা যে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন, তার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারছে সাধারণ মানুষ।  জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন আজ স্বীকৃত সত্য। বিভিন্ন গবেষণাপত্রেও গত একশ বছরের পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট  করে দেখানো হয়েছে। ইতঃপূর্বে বিজ্ঞানীরা যেমন আশঙ্কা করেছেন, এখনো তাদের সেই আশঙ্কার কারণে আজ সাধারণের মাঝেও ভীতির জন্ম দিচ্ছে। কারণ একথা স্পষ্ট,  যেভাবে বায়ুমণ্ডল এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, যেভাবে মেরু অঞ্চলের বরফর গলছে, এই ধারা যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে সামনে যে দুর্যোগ অপেক্ষা করছে তা কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাবে না। যদিও আমাদের সাধ্যানুযায়ী আমাদের সরকার জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কাজ করে চলেছে। গাছ লাগানো, নদী-খালকে তাদের গতিপথ ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কর্মসূচির পাশাপাশি ভবিষ্যতের হুমকি মোকাবিলার জন্য সরকার ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে এবং আরো আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপকে ঘিরে গ্রহণ করেছে ডেলটা প্ল্যান ২১০০।

সম্প্রতি জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের একটি প্যানেল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানায়, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে ১.১ মিটার পর্যন্ত। আর এমন হলে তলিয়ে যাবে অনেক দেশ। মানুষের নানান কর্মকাণ্ডের ফলেই বায়ুতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়েছে। যার ফলে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন মেরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলছে, এতে বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। পরিস্থিতির এই বিপজ্জনক অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়েই আমাদের সতর্ক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ধনী দেশগুলোর দায়িত্ব বেশি হলেও, আমাদেরও হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পৃথিবীর উত্তপ্ত হওয়া ঠেকাতে হবে। এ লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঁচ প্রস্তাব। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছিল, কোনোভাবেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঠেকাতে হলে সব দেশকেই প্যারিস চুক্তির শর্ত মানা জরুরি, যা প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবনার মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে বিপদ সংকেত বেজে উঠেছে তা সবার জন্যই সমান প্রয়োজ্য। সেই বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদেরকেও সচেতনতার সঙ্গে প্রস্তুত থাকতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনা ইতিবাচক এবং আজকের ও আগামীর বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায়ও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads