• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

পরিবেশের স্বার্থে পরিকল্পিত ভূমির ব্যবহার প্রয়োজন

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ২২ অক্টোবর ২০২১

দেশে প্রতি বছর কৃষি জমির পরিমাণ কমছে ১ শতাংশ হারে। অন্যদিকে প্রতি বছর বাড়ছে জনসংখ্যা। ফলে খাদ্য উৎপাদনেও সৃষ্টি হচ্ছে বাড়তি চাপ। এ অবস্থায় ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার ও উন্নয়ন নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে বেশ কিছুদিন থেকে। এর ফল হিসেবে গত বছর ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন-২০১৭’-এর নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার। এর ফলে এখন থেকে শহর-নগরের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জেও ঘরবাড়ি বা অন্যবিধ স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে লিখিত অনুমোদন লাগবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে গ্রামাঞ্চলে ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতির বিধান থাকলেও সেটি প্রতিপালিত হয় না কোথাও। ফলে কৃষি জমিসহ ভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার এমনকি অপব্যবহার বেড়েছে ক্রমেই। যে যেখানে খুশি মর্জিমাফিক গড়ে তুলেছে বসতবাড়ি কিংবা অন্যবিধ স্থাপনা। বাগানবাড়ি, পার্ক এমনকি শিল্পকারখানা। ফলে দিনদিন ভূমি, বিশেষ করে কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। অনেক স্থানে এমনও দেখা যায়, ধানের জমির মাঝখানে অথবা জলাশয় ভরাট করে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর। অনেক ক্ষেত্রে নদনদীসহ অবৈধ দখলের অভিযোগও আছে। বেদখলে বনভূমিও উজাড় হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন কৃষি জমির পরিমাণ কমছে, অন্যদিকে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাশয়, লোপাট হচ্ছে বনভূমি।

১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে শাস্তির বিধান ছিল না। এমনকি লিখিত অনুমোদনের বিধান থাকলেও তা মানা হতো না। কিন্তু এখন থেকে তা মানতে হবে। আর না মানলে অভিযুক্তের জন্য পাঁচ বছর কারাদণ্ডের সঙ্গে ৫০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ক্ষেত্রমতে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, রাজধানীতে রাজউক, চট্টগ্রামে চসিক এ অনুমোদন দিয়ে থাকে। ভবিষ্যতে এই ক্ষমতা ইউনিয়ন পরিষদের হাতেও দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে আইনটিতে। গ্রামে বাড়িঘর ও উন্নয়নমূলক কাজের আগে এখন থেকে ইউনিয়ন পরিষদের লিখিত অনুমোদন নিতে হবে।

ঢাকা শহরের বাতাসে এখন কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রদাহ বেড়ে চলেছে। শ্বাসতন্ত্রের নানাবিধ জটিল রোগ এখন শিশুদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব শিশু অ্যাজমা ও ফুসফুসের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অল্প বয়সেই। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বায়ুদূষণ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। বাংলাদেশে এই বায়ুদূষণের একটি অন্যতম কারণ কয়লা ও জৈব জ্বালানি, ইটভাটা, শিল্পকারখানার বর্জ্য ও ধোঁয়া। আর এ ক্ষেত্রে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে রাজধানীর ঢাকার অভ্যন্তরে যত্রতত্র গড়ে ওঠা শিল্পখানাগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বর্জ্য নিষ্কাশন ও ধোঁয়া নির্গমন ঢাকার পরিবেশকে জীবনধারণের ক্ষেত্রে হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে।

এ পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরে কলকারখানা স্থানান্তরে সরকারের উদ্যোগ জনমনে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর আওতায় সাভারে ১৯৯ দশমিক ৪০ একর জমির ওপর অত্যাধুনিক ও পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার অভ্যন্তরে যত্রতত্র গড়ে ওঠা প্লাস্টিক ও মুদ্রণশিল্পগুলোকে স্থানান্তরের জন্য মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে শিল্পনগরী স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া ইলেকট্রিক্যাল শিল্পকারখানা টঙ্গীবাড়ী স্থানান্তরের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ঢাকা নগরীকে পরিবেশদূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং নগরবাসীর সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনধারণের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব নগরায়ণ উপহার দিতে এ ধরনের পদক্ষেপের বিকল্প নেই। আর এর মাধ্যমেই পরিকল্পিত ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। টেকসই বৈশ্বিক জলবায়ুর ক্ষেত্রে করণীয় বিবেচনায় নিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, মহানগরী ঢাকার বর্তমান পরিবেশ জনসাধারণের স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য হুমকিস্বরূপ।

ঢাকার জনজীবন যে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মাত্রাতিরিক্ত যানজট, অসম্ভব বায়ুদূষণ, চলাচলে নিরাপত্তাহীনতা, খাদ্যে ভেজাল, জনসেবার প্রতিটি ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি নগরবাসীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ রোগব্যাধি বহুগুণ বেড়ে গেছে। এ থেকে মুক্তি নেই আজকের জন্ম নেওয়া শিশুটিরও। মানবদেহের জন্য মারাত্মক উপাদান পিএম ২.৫ ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে বায়ুতে বিরাজ করছে। বাংলাদেশে মূলত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ও ধুলার মাধ্যমে বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানো, ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধোঁয়া ও ধুলায় এগুলোর সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এসব নির্মাণসামগ্রী, বিশেষ করে বালু ও ইট পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে বায়ুদূষণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। ফলে বাতাসে উড়ে বেড়ানো ধুলাবালি সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের নানবিধ রোগের জন্ম দিচ্ছে এবং হূদরোগের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। উপরন্তু বায়ুতে বিদ্যমান ক্ষতিকর উপাদান পিএম ২.৫-এর কারণে অ্যাজমা এখন বাংলাদেশের শিশু থেকে শুরু করে যে-কোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এর মাধ্যমে ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। এই পরিবেশদূষণ ক্রমেই রাজধানী ঢাকা ছেড়ে দেশের বড় বড় শহরকেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন-২০১৭-এর বাস্তবায়ন যেমন জরুরি, তেমনি এটি একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্তও বটে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত শিল্প ও নির্মাণ আইন মানতে সরকারকে কঠোর হাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আয়তনের দিক থেকে ছোট এই বাংলাদেশকে পরিকল্পিত উপায়ে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে এ ধরনের প্রয়াসের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করার উপায় নেই।    

যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের বেশ কিছু অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত উন্নয়ন দেশেবিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে। একদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ, অন্যদিকে দেশব্যাপী যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন দৃশ্যমান। বিদ্যুত উৎপাদনে বৈপ্লবিক সফলতা সহসাই যেন ধরা দিয়েছে। কিন্তু এসব অর্জন টেকসই করতে প্রয়োজন একটি সুস্থির জনজীবন। আর তার জন্যে জরুরি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়ন। পাশাপাশি জীবনধারণের জন্য উন্নয়ন ঘটাতে হবে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও। জননিরাপত্তা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন ছাড়া কোনো জাতির মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সততা, দেশপ্রেম—এসব গুণের বিকাশ ঘটে না। তাই উন্নয়নের প্রচেষ্টাকে অর্থবহ করতে হলে একরৈখিক নয়, প্রয়োজন সামগ্রিক উন্নয়ন। সুতরাং আমাদের এখন নজর দিতে হবে রাষ্ট্রীয় সেবাগুলোর মানবৃদ্ধির দিকে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষের বসবাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টিতে রাষ্ট্র তার অর্পিত দায়িত্ব পালনে গুরুত্ব দেবে।

এ রকম একটি যুগোপযোগী আইন  প্রণয়ন এবং তা মানার বাধ্যবাধকতা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ শহর ও গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের বিকাশসহ ছোট-বড় শিল্পকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। তবে এসবের অধিকাংশই অপরিকল্পিত, ভূমির ব্যবহার যথেচ্ছ এবং কোথাওবা অবৈধ। সরকারি খাসজমি এমনকি জলাশয়, নদনদী দখল করেও চলছে নির্মাণ। প্রায় গ্রামেই এখন প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমজীবীদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ বাড়ছে এবং বাড়িঘর নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। এর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কৃষি জমিও। নিজের সম্পত্তি বলে কথা! উচ্চমূল্যে জমি কেনার খবরও আছে। আরো একটি উৎকট উপদ্রব যত্রতত্র ইটভাটি ও চিমনির ধোঁয়া। ভয়াবহ পরিবেশদূষণের পাশাপাশি ভূমির পরিমাণ কমে যাওয়ার জন্য এটিও কম দায়ী নয়। এতে খাদ্য নিরাপত্তাসহ খাদ্যশৃঙ্খলে সৃষ্টি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত চাপ। ব্যাপক উন্নয়নের জন্য ইটভাটি, শিল্পকারখানার অবকাঠামো নির্মাণ, ঘরবাড়ি, আবাসন ইত্যাদি অপরিহার্য। তবে ভূমির পরিমাণ যেহেতু সীমাবদ্ধ ও সীমিত, সেহেতু তা অবশ্যই পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহারের দাবি রাখে। সেটাও হতে হবে সুষ্ঠু, সমন্বিত, সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব। আর তাই সরকারের ‘নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন’ বাস্তবায়নের বিকল্প কিছু নেই। সাধারণ মানুষ এখন এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ দেখতে চায়। এর ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচবে। পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।

 

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads