• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

আমার উপলব্ধিতে বঙ্গবন্ধু

  • প্রকাশিত ০৫ নভেম্বর ২০২১

এম এ হান্নান মিঞা

 

বাঙালি জাতির শোকের মাস আগস্ট মাস। আগস্ট মাস আসলেই বাঙালি জাতি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে। এই মাসেই বিশ্বাসঘাতক কিছু নরপিশাচের হাতে নিহত হয়েছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সপরিবারে। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ এক অনন্য নাম, একই সুতোয় গাঁথা। বঙ্গবন্ধুকে দেশের গণ্ডির মধ্যে রাখলে হয়তো তার পরিসীমা ছোট করা হবে। শুধু দেশ নয় সারা বিশ্বেই বঙ্গবন্ধু রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কারো একার নয়, তিনি সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহান বিপ্লবী নেতাদের একজন।

বঙ্গবন্ধুই ছিলেন বিশ্বের একমাত্র শোষিত, বঞ্চিত, নিম্ন শ্রেণির লোকের নেতা। পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো নিপীড়িত শোষিতের পক্ষে তেমন আর কাউকেই পাওয়া যায় না। তিনি ধূমকেতুর মতো জন্মেছিলেন বাংলার মাটিতে, ভালবেসেছিলেন বাংলার জনসাধারণকে। সমস্ত বাঙালির হূদয় তার হূদয় হয়ে গেল। তার কথামতোই সমস্ত দেশ-জাতি পরিচালিত হতে লাগল। একসময় শেক মুজিবুর রহমান থেকে হয়ে গেলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী ছিলেন তার তুলনা করা কঠিন। তিনি জানতেন আগামীতে কী ঘটতে যাচ্ছে, যা বিশ্বের অন্য কোনো নেতার পক্ষে বলা সম্ভব হতো না। তার মেধা-স্মৃতিশক্তি এতটা প্রখর ছিল যে, যুগের বেশি সময় পরও অতীতের কথা হুবহু বলতে পারতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক কাছে থাকতেন আবদুল মজিদ হাওলাদার (স্পেশাল সিআইডি অফিসার)। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথেও তার বেশ ভালো সুসম্পর্ক ছিল। তিনি অবসর সময়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রায়ই কাঁদতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কত বড় মায়া মমতা হূদয়ে ছিল, তা অন্য কারো মধ্যে ছিল বলে জানা যায় না। তিনি খাওয়ার সময় একা কখনো খেতে বসতেন না। বাড়ির কর্মচারী হোক, আর বাইরের লোকই হোক, যাকে পেতেন তাকে নিয়েই এক স্থানে বসে খাবার খেতেন। অধিকাংশ সময় আবদুল মজিদ হাওলাদার বাসার গেটেই দায়িত্ব পালন করতেন। তাই অনেক সময় মজিদ হাওলাদারকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে কথা বলতেন। যখন জাতির পিতা বাসায় থাকতেন না, তখন বঙ্গমাতা মজিদ হাওলাদারকে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলতেন এবং ঘরে থাকা বিভিন্ন ধরনের খাবার নিজের হাতেই পরিবেশন করতেন।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে বললেন, ’৬৬ সালে ৬-দফা পেশ করা হয়েছে, পাকিস্তানিরা তখন বঙ্গবন্ধুকে থামানোর জন্যে বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল শুরু করেছে। তাকে কোনোভাবেই বাগে আনতে পারছে না। তাকে গ্রেফতারের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তখন বঙ্গবন্ধু ৬-দফার সুফলগুলোকে জানানোর জন্যে দেশব্যাপী জনসভা করছেন। একদিন চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে মিটিং শেষে ঢাকার পথে ফিরছেন, চট্টগ্রাম ছেড়ে যখন তার গাড়ি কুমিল্লায় পৌঁছেছে, চান্দিনা দিয়ে গাড়ি চলছে, ঠিক চান্দিনা চৌরাস্তায় এলে একজন লোক তাকে সংবাদ দিলো যে, তাকে গ্রেফতার করার জন্যে পাকিস্তান বাহিনী কুমিল্লার দিকে আসছে। সংবাদ শুনে তিনি লোকজনদের বললেন, আগামীকাল সিলেটে আমাকে জনসভা করতেই হবে। তাহলে উপায় কী? নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো- সঙ্গীরা সবাই ঢাকায় ফিরে যাবে আর বঙ্গবন্ধু একাই ওইখানে রয়ে যাবেন এবং কালকে সিলেটের জনসভায় বক্তৃতা করবেন। যে কথা সেই কাজ। বঙ্গবন্ধু একাই কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একজন লোককে ডেকে নিয়ে এলেন অন্ধকার রাতে পথ দেখানোর জন্যে এবং তাকে সাথী হিসাবে নিয়ে রওনা দিলেন সিলেটের পথে। প্রায় ২০/২২ মাইল পথ অতিক্রম করে সুরমা নদের পাড়ে পৌঁছালেন। একটা জেলে নৌকা ডেকে পার হওয়ার ব্যবস্থা হলে সঙ্গের লোকটি সেখান থেকেই বিদায় নিলেন। পথে শুধু তার সাথে কথা বললেন কিন্তু চেহারা দেখতে পেলেন না। কিন্তু সেই পথিকের নামটা মাঝে কথাপ্রসঙ্গে জেনে নিলেন— নাম আক্কাস। তার সাথে আর কোনোদিনই দেখা হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালের দিকে দুপুরে বঙ্গবন্ধু বাসায় ফিরছেন, রুমের ভিতরে ঢুকতে যাবেন, ঠিক সে সময় পর্দার আড়ালে লুকানো লোকটার কান ধরে টেনে বের করে এনে বললেন, তুই তো সেই আক্কাস, আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে অন্ধকার রাতে বৃষ্টিতে ভিজে আমাকে নদীর পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছিলি না? আমি তোকে ঠিকই চিনতে পেরেছি। কথাগুলো বঙ্গবন্ধু নিজের মুখেই সবার সামনে বললেন।

বঙ্গবন্ধু সত্তর দশকে ফরিদপুরের সদরপুরে এসেছিলেন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষ্ণপুর ইউনিয়ন দেখতে। সেদিন স্বচোখে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখেন, তাদের সাথে কথা বলেন, তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে নিজেও কান্নার ভেঙে পড়েন। সেদিন তাকে এক নজর দেখার জন্যে, তার মুখের একটা কথা শোনার জন্যে, বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার লোকজনসহ অনেক অঞ্চল থেকেই লোকজন এসে জনসমুদ্রে পরিণত করেন। এ থেকেই বোঝা যায় বাঙালি জাতির হূদয়ে বঙ্গবন্ধু কতখানি জায়গা করে নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার দেয়া কথা রেখেছিলেন, তিনি বলেছিলেন— এই বাঙালির ঋণ আমি আমার বুকের রক্ত দিয়ে শোধ করে দিব। ঠিক তা-ই হলো। বেঈমান-বিশ্বাসঘাতকের বুলেটে তাকে হত্যা করা হলো। সেদিনের ১৫ আগস্ট দেখে বিশ্ববাসী শোকে স্তব্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে যে কথা বলেছিলেন তা তিনি দায়িত্বের সাথেই পালন করেছিলেন। তার রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজগুলো মমতাময়ী, জননেত্রী শেখ হাসিনা সম্পন্ন করে চলেছেন। তার আদর্শের শোষণমুক্ত, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, সোনার বাংলা গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জাতির পিতার মতো তিনিও উচ্চারণ করছেন— দুর্নীতি, শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার।

আমাদের দেশে এখনো অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজ ও আচরণে অন্য এক ধরনের ভাব লক্ষ করা যায়, যা তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে করে থাকেন। আবার অনেককে দেখা যায় যে বেতন পান তা তার জীবনযাপনের সাথে ঠিক যায় না। তখন প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক, তাহলে বাড়তি টাকাটা কোথা থেকে আসে! বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা কোথায় যায়? নানা জায়গা থেকে আর্থিক সুবিধা লাভ এখন অনেকের কাছে সাধারণ হয়ে গেছে। সাধারণত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ও চাহিদার বহিঃপ্রকাশ সাংবাদিকদের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছায়। সংবাদকর্মীরা জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত নানা সমস্যা, হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেন। জনগণ হয়তো সবসময় সরকারের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ নাও করতে পারেন, তখন সাংবাদিকরা সেই তথ্যপ্রাপ্তিতে সহায়তা করেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিংসা, সড়ক, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ অথবা প্রকল্পের ব্যয়— এসব সাংবাদিকরা বা জনগণ জানলে সমস্যা না হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সমস্যা, কারণ বেশিরভাগ প্রকল্পে রয়েছে দুর্নীতির চিত্র।

১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। কারা এই দুর্নীতির সাথে জড়িত, কারা এই এই দুর্নীতি করে, তবে আমার বাংলার খেটে খাওয়া মেহনতি কৃষক-শ্রমিক দুর্নীতি করে না। এ বাংলার মাটি থেকে চিরতরে দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে, তা না হলে দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। দুর্নীতি আমার বাংলার মজদুর করে না। দুর্নীতি করি আমরা যারা শিক্ষিত সমাজ। শিক্ষিত হয়ে দুর্নীতির পথে আগাই।’ আজকে দুর্নীতি যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। বিদেশে গেলেও দেখা যাবে আমরা দুর্নীতি করে যাচ্ছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী, জননেত্রী শেখ হাসিনা বেশ শক্ত হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরেছেন। মনে হচ্ছে আগামীতে হয়তো দুর্নীতি প্রশ্রয় পাবে না। জাতির পিতার কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলায় পরিণত হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই প্রকাশ্যে সঠিক সত্য, ন্যায়পরায়ণ, নিষ্ঠাবান, অন্যায়ের কাছে শির টান করে কথা বলেছিলেন। সর্বদা শোষিতের পক্ষে কাজ করে যেতেন। পরিশেষে বলতে চাই, যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির হূদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

                                                                                                                                                                                                                              

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads