• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

উন্নয়ন ও অগ্রগতির বড় শত্রু দুর্নীতি

  • প্রকাশিত ১১ ডিসেম্বর ২০২১

মো. জিল্লুর রহমান

 

বর্তমানে উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং দুর্নীতি একথাগুলো মানুষের মুখে মুখে খুবই প্রচলিত। কেননা উন্নয়ন কাজকে ত্বরান্বিত করতে যেটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা হলো দুর্নীতি। নৈতিকভাবে উন্নত, সৎ, বিবেকবান মানুষ যে পদেই থাকুন কেন, তিনি সমাজ ও জাতির বড় সম্পদ। তাকে দিয়ে উপকার না হলেও অন্তত কারো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। অপরদিকে নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তি যতই উচ্চ আসনে অবস্থান করুক না কেন, তিনি মোটেও শ্রদ্ধার পাত্র নন। পদমর্যাদার কারণে তাকে হয়তো মানুষ সামনে কিছু বলে না কিন্তু পেছনে অন্তর থেকে ঘৃণা করে। তার দ্বারা উপকারের চেয়ে দেশ ও জাতির ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

দুর্নীতি বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি, স্বাভাবিক নিয়মনীতির গতিধারাকে লঙ্ঘন করে কোন কাজ করা যা কোন ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি এক ভয়াবহ অভিশাপ। এটি হলো এক ধরনের অপরাধমূলক ঘৃণিত কাজ যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শের পরিপন্থী। দুর্নীতি জাতির সব অর্জনকে এবং জাতীয় উন্নয়নের সব সম্ভাবনাকে ম্লান করে দেয়।

কারণ দুর্নীতিবাজ স্বার্থান্ধ, বিবেকবর্জিত। তিনি সবসময় নিজের স্বার্থসিদ্ধির মতলবে থাকেন। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। সমাজের কল্যাণ, দেশের মঙ্গলের কথা তিনি চিন্তা করেন না। জাতীয় জীবনের উন্নতি, সমৃদ্ধির কথা ভাবতে তার বিবেক সায় দেয় না। এজন্য বিবেকবর্জিত, দুর্নীতিগ্রস্ত লোক দেশের সব উন্নতির পথে বাধাস্বরূপ, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির বড় শত্রু।

বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) পরিচালিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। গত বছর টিআই বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) ২০২০ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত রিপোর্টে দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দুই ধাপ পিছিয়েছে। মোট ১৮০টি দেশের তথ্য নিয়ে সংস্থাটি সিপিআই ২০২০ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র আফগানিস্তানই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান, দেশটির স্কোর ৬৮। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৯ সালে ছিল ১৪তম। সূচকে উচ্চক্রম (ভালো থেকে খারাপের দিকে) অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এবারও বাংলাদেশ ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। ১২তম অবস্থানে আরো রয়েছে উজবেকিস্তান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।

টিআইবির মতে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের দুর্নীতির পেছনের অন্যতম একটি কারণ হলো, বাস্তবে উচ্চ শ্রেণির দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার যথাযথ বাস্তবায়ন না করা। সূচক অনুযায়ী, সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক। এরপরেই রয়েছে নিউজিল্যান্ড। দেশ দুটির স্কোর ৮৮। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত আফ্রিকান দেশ দক্ষিণ সুদান এবং সোমালিয়া। দেশ দুটির স্কোর ১২। উল্লেখ্য, টিআইর দুর্নীতির ধারণাসূচকে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছিল তালিকার এক নম্বরে!

আসলে ঘুষ ও দুর্নীতি যে কোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবচেয়ে বড় শত্রু। বাংলাদেশের দুর্নীতির আওতা ও পরিধি এতটাই ব্যাপক যে, একে কয়েক লাইনের একটি প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ঘুষ ও দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ একটি ঘৃণিত অপরাধমূলক কাজ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘুষ ও দুর্নীতি একটি ভয়াবহ অভিশাপ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণসহ সর্বোপরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে কঠিনতম অন্তরায় দুর্নীতি, তথাপি দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যায় না।

বহুল আলোচিত রূপপুরের বালিশ কাণ্ড, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারি, ক্যাসিনো কাণ্ড, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপের দুর্নীতি, সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের অর্থ লোপাট ইত্যাদি সাম্প্রতিক বছরগুলোর আলোচিত-সমালোচিত দুর্নীতির ঘটনা। এসব ঘটনা ও কেলেঙ্কারি আমাদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য বড় বড় ক্ষত এবং দুর্নীতি প্রতিরোধের বিশাল হুমকি ও চ্যালেঞ্জ।

 

পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির জাতীয় উন্নয়নের প্রধান বিষয়গুলো হলো— মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ, রাজনীতিতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা। জাতীয় জীবনের উন্নতির জন্য প্রত্যেক জাতিকে তাই সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে হয়। ন্যায়নীতি, সততা ও স্বচ্ছতা জাতিকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিশ্রমী জাতিই উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু জাতীয় জীবনে দুর্নীতি প্রবেশ করলে জাতির সকল উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দুর্নীতির করাল গ্রাসে একটি সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। দুর্নীতি সামাজিক বৈষম্য, স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র প্রভৃতির মাধ্যমে জাতীয় অনৈক্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এই সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধির মরণ ছোবল থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে পারলেই জাতির উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য প্রত্যেক জাতিকে দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দুর্নীতি সৃষ্টির কারণ খুঁজে বের করতে হবে। দুর্নীতি মোকাবিলায় সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত হলো দুর্নীতি মুক্ত হওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে বইছে দুর্নীতির কালো অধ্যায়, সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কালো থাবার প্রভাবে আচ্ছন্ন প্রতিটি নাগরিকের জীবন। সর্বনাশা এই ব্যাধি দেশকে আজ হুমকির সম্মুখীন করেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ নীতি, শিল্প বাণিজ্য, ব্যবসাসহ সকল ক্ষেত্রেই চলছে দুর্নীতির তাণ্ডবলীলা।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, দুর্নীতিই আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা। দুর্নীতি যে কোনো দেশেরই উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক সাম্য ও গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দুর্নীতি রয়েছে। এই দুর্নীতির ব্যাপকতা, প্রকৃতি, মাত্রা, ক্ষেত্র এবং কৌশল ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুষ দুর্নীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

টিআইবি ২০১৭ সালে সরকারের ১৫টি সেবা খাতে ঘুষ দুর্নীতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় ২০১৭ সালে সেবা খাতে মোট ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৮৮.৯ কোটি টাকা। এটা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ৩.৪ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৫ ভাগ। ২০১৫ সালের বছরের তুলনায় এটা ২১.২ ভাগ বেড়েছে। সাধারণ মানুষ কেন ঘুষ দেয়? এর উত্তরে টিআই বলছে, ‘গবেষণায় যে ৬৯ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন তাদের ৮৯ শতাংশ বলেছেন তারা ঘুষ দিতে বাধ্য। কারণ তারা যদি ঘুষ না দেন তাহলে সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন।

 

টিআইবির মতে, বাংলাদেশের দুর্নীতির সম্ভাব্য কারণগুলো হলো— দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার এবং এর বাস্তবায়নের মিল না থাকা; উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা ও আমলাদের দুর্নীতি চিহ্নিত না করা; সরকার ও রাজনৈতিক দলসহ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারা; আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি পাওয়া; ভূমি-নদী-খালবিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না কমা; অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া; দুর্বল জবাবদিহিতা; দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব; দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধে সবার জন্য আইন সমান, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা।

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা মনে করেন যে, দুর্নীতির জন্য ৯০ ভাগ দায়ী রাজনৈতিক নেতারা। তাদের নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। তারা বলেন, দুর্নীতি থেকে উত্তরণের একটি সুচিন্তিত পথ হলো দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকিয়ে আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হলে রাজনৈতিক নেতারা ও আমলাদের সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ সব সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের সদিচ্ছা ছাড়া কখনো দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না।

দুর্নীতি বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে একটি বড় ব্যাধি। এটি দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন ব্যাহত করে চলছে যুগের পর যুগ। দুর্নীতি দমন কোনো সরকারের পক্ষে এককভাবে দমন করা সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরে মূল্যবোধ সৃষ্টি এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে আমাদের। শুধু সরকার বা রাজনৈতিক দলের নয়, সরকারের পাশাপাশি সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদেরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। রোগের চিকিৎসার চেয়ে যদি রোগ প্রতিরোধ করা যায়, তাহলে বেশি কাজে দেয়। আমরা যদি আমাদের শুভবুদ্ধি, মূল্যবোধ, দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে পারি, তাহলেই দুর্নীতি নামক জাতীয় ব্যাধি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

 

লেখক : ব্যাংকার ও মুক্তগদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads