• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মানবতার বাস্তুসংস্থান আজ হুমকির মুখে

  • প্রকাশিত ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

সাঈদ চৌধুরী

 

বর্তমান সময়ে যারা অভিভাবক রয়েছেন, তাদের মূল চাওয়ার জায়গা কোনটি তাদের সন্তানদের কাছে জানেন কি? এক কথায় অনেকে উত্তর দেবেন—আমরা চাই আমাদের সন্তান ভালোভাবে পড়াশোনা করুক। সবশেষে গিয়ে তিনি বলবেন আমার সন্তানকে এ প্লাস পেতেই হবে! এই প্লাস কথাটি এখন খুব সাধারণ, আলোচনাও হয়েছে অনেক; কিন্তু আদৌ কি কেউ একটু সরে এসেছে তাদের নিজস্বতা থেকে?

বুদ্ধিজীবীগণ তাদের কথা তারা বলেন আর অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে তাদের মতো করে গড়ে তুলতে চান। এভাবে সবার মধ্যে এমন একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে যা বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালেই সপষ্ট হওয়া যায়। বইয়ের বোঝা কমানোর একটি রব উঠেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাইছেন শিশুরা কম চাপে থাকুক। কিন্তু শিশুটির বাবা-মা কি চাইছে?

সন্তান স্কুলে যাবে, তার আগে ও পড়ে প্রাইভেট পড়বে এবং বিকেলে কোচিংয়ে গিয়ে সব পড়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়বে এবং সকাল হলে সে আবার স্কুলে যাবে! নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জীবন চালানো মানে এমনিভাবেই সন্তানদের মানুষ করার মেশিনে পরিণত করছে বাবা-মা! তখন করোনা জেঁকে বসেনি, একটি স্কুলের অভিভাবক সমাবেশে গিয়েছিলাম। অনেক অভিভাবকের অনেক কথা শুনলাম। তার মধ্যে একজন শিক্ষক মা এসেছিলেন। তিনি অন্য আরেকটি স্কুলের শিক্ষক। তার সন্তান সমপর্কে কথা বলতে শুনছিলাম। স্কুল সম্পর্কে তার বিস্তর বর্ণনা। তিনি আগে যখন সন্তানকে স্কুলে দিয়েছেন, তখন স্কুলের পারফরমেন্স আরও ভালো ছিলো। তখন এ প্লাস আরও বেশি পেত কিন্তু এখন দিন দিন স্কুলের মান খারাপ হচ্ছে! তিনি নির্ভরতার জায়গাটিতে একেবারেই হতাশ।

নিজ সন্তানের কথা বলতে গিয়েও তিনি বললেন তার আগের মতো তেমন ভালো ছাত্রত্ব নেই। এখন তেমন পড়তে চায় না। শেষে গিয়ে বললেন, আমার সন্তানও এভাবে পড়লে আর এ প্লাস পাবে না। তিনি অন্য স্কুলে পড়ান বলে তেমনভাবে সন্তাানের খোঁজখবরও নিতে পারেন না। সবকিছু মিলে তার সন্তান এ প্লাস না পেলে তিনি এটা মেনে নিতে পারবেন না বলেই ধরে নেয়া যায়!

একজন শিক্ষক হয়ে তিনি যেভাবে চাইছেন, তার ভাবনায় বেশ অবাক হলাম। আমরা যারা শৈশব শৈশব করে চিল্লাচিল্লি করছি, তারা যদি সচেতন মানুষ নিজেদের মনে করে থাকেন; তবে একজন শিক্ষকও তো সচেতন মানুষ! দিন শেষে সবার যে ধরনের অভিব্যক্তি তাতে শিশুদের জীবনবোধ সমপর্কে জ্ঞান দেয়া তো দূরে থাক, তাদের উপর বোঝা যে যত চাপিয়ে দিতে পারে এ প্রতিযোগিতাই যেন অভিভাবকত্ব! এখন আমরা যারা সন্তানদের শিশু সুলভ আচরণ চাই তারা যখন অভিভাবক হয়ে কোনো স্কুলে কথা বলব এবং শুধু এ প্লাস যারা চায় তারা যখন কথা বলবে—এই দুই কথার মধ্যে ব্যবধান থাকবে অনেক। স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইবে তাদের ছাত্র-ছাত্রী বেশি হোক, শুধু এ কারণে তারাও করপোরেট দিকেই এগুবে।

পরিবার, সমাজ ও স্কুল কোনো জায়গায় যদি একজন ছেলে বা মেয়ে নৈতিকতার শিক্ষা না পায়, তখন কিন্তু সত্যিই এ চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়বে এবং পড়ছেও কিন্তু তাই। ঘটনায় ঘটনায় চাপা পড়ে যাচ্ছি আমরা। ভুলে যাচ্ছি সব, অথচ যে পরিবার বা ব্যক্তি অনৈতিকতার মধ্যে পড়ছে কেবল তারাই বুঝতে পারছে জীবন কতটা কঠিন হয়ে গিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের পর কতগুলো বিষয় আলোচনায় আসলো! তার মধ্যে একটি বিষয় খুব উদ্বেগজনক মনে হয়েছে। তা হলো ধর্ষককে ধরার পর তার শারীরিক গঠনে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি এই লোকই আসলে ধর্ষক হতে পারে! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি এমন বিশ্বাসহীনতার বিষয়টি ভাববার বিষয়। প্রতিনিয়তই এমন হচ্ছে। কোনো আসামীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরার পর অনেকেই ধারণা করছে টাকা দিলেই ছেড়ে দেবে! বিচারহীনতা বা নাগরিক অবিশ্বস্ততার জায়গা তৈরি হওয়া ভালো কোনো বিষয় হতে পারে না।

মানবিক আচরণের ক্ষেত্রে অনেক কিছু যখন আমরা মডেল হিসেবে দাঁড় করে দিয়ে বলছি— এগুলো শুধুই ডামি, তখনও কিন্তু কিছ কিছু বিষয় সত্যরূপে আমাদের সামনে চলে আসছে। কিছুদিন আগে দেখলাম ঢাকার রাস্তায় ‘মানব কুকুর’ নামে একটি কালচারকে সামনে নিয়ে আসা হলো! যদিও বলা হচ্ছিল বিষয়টি ফেক বা অভিনয়ের কারণেই, কিন্তু এ বিষয়টি কারও মধ্যে ঢুকে যেতে পারে এবং এরকম প্রমাণ অতীতেও রয়েছে। আমাদেরকে খুব দূরে যেতেও হবে না ঘটনা প্রমাণের জন্য। যদি দেখে থাকেন বর্তমান অপরাধগুলো, তবে বুঝে থাকবেন অপরাধগুলোও খুব চতুরভাবে করা হয় এখন। অপরাধীরা দিন দিনই খুব কৌশলী হয়ে যাচ্ছে। আর এখানেও বড় ভূমিকা আছে টেলিভিশন সংস্কৃতির। আমরা যখন অনুষ্ঠানগুলো দেখি, বিশেষ করে শিশুদের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় তারা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে এবং কাজগুলো নিজেরাই করতে চাইছে! অপরাধীরাও ক্রাইমভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলো দেখেই কিন্তু তারা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে এবং এরকম অপরাধগুলো করে বেড়াচ্ছে!

দেখে শিক্ষার জায়গায়ও আমরা ব্যর্থ হচ্ছি দিন দিনই। বর্তমানে সকল স্তরে খারাপ কাজ এতটা বেড়েছে যে আমাদের সামনে এখন অনেক ভালো কাজও উদাহরণ হওয়া সময় পায় না। মানবিকতার বাস্তুসংস্থানে অনেকগুলো স্তর এখন ভঙ্গুর। যদি এই ভঙ্গুরতার শুরুর কাল নির্বাচন করতে বলা হয়, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যখন থেকে শিক্ষার সঠিক প্রকাশ ও মানে পরিবর্তিত হয়েছে এবং অর্থকে যখন থেকে যে কোনো উপায়ে সংগ্রহের মাধ্যম বিবেচনা করা হয়েছে তখন থেকেই মূলত আমাদের সবদিক দিয়ে সংকীর্ণতা বাড়তে শুরু করেছে।

যখন ভাবা হচ্ছে—আইনই পারে সব অনিয়ম দূর করতে, তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে আইনের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে গিয়ে কি আমরা সামাজিক পরিবেশ ও পরিবারের দায় কমিয়ে দিচ্ছি না? ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে যেভাবে সংসারে একে অপরের সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে তা যেমন সকল অশান্তির কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে, তেমনি অপরাধ সৃষ্টির বড় কারণ হয়ে উঠছে দুর্নীতি এবং নেশা! আর এই নেশার জায়গা তৈরি হচ্ছে আমাদের খুব কাছেই, হয়তো পাশের ঘরেই বা আমাদের শোয়ার ঘরে পাশের বালিশেই। কারণ একটি অ্যান্ড্রয়েট যা দিচ্ছে একটি শিশুকে, তার পুরোটাই হল ফেক কোনো জিনিসের ব্যাপ্তি। এখন আমরা যে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তাতে এমন একটি সময় এক সময় আসতে পারে কখনো, যখন মানুষ আবার আদিমে ফিরতে চাইবে, মানুষ আবার মোবাইল ছাড়া একাকী বাঁচতে চাইবে! তবে আমরা চাই ডিজিটালাইজেশন ও মানবিকতা একসসঙ্গ পথ চলুক। যদি এগুলো একসাথে অর্জন সম্ভব না হয় তবে কখনই মানবিকতার প্রসার ঘটবে না।

সমাজ ভেঙে, সভ্যতার উন্নতি ঘটে ঘটে আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে তার নাম আধুনিকতা। আর এর বাইরে যা আছে তার নাম অমানবিকতার প্রসার! যখনই কোনো অঘটন ঘটে, তখনই আমরা তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু নিজেরা কখনই কোনো কাজ করে সফলতার দিকে এগুতে পারি না। প্রতিবন্ধকতাগুলো নিয়েও কাজ করার সময় এসেছে। স্কুলিং ব্যবস্থায় কাউন্সিলিং জরুরি যাতে তাদের নৈতিক শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। ধর্ম চর্চায় সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে, রয়েছে মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা বাড়ানোর ক্ষেত্র সৃষ্টিতে কাজ করা।

বাস্তুসংস্থানের যে অংশে আজ ক্ষত, সেই অংশে কাজ করার আগে পুরো পরিবেশ নিয়েই আমাদের জানতে হবে। আর এভাবেই আমরা পারবো সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ানোর মতো মহৎ কাজটি করতে। সময় এসেছে এখন এসবকিছু নিয়ে সমাজ-মানুষের চিন্তার প্রসার ঘটানো। রাষ্ট্রকে এখনি এগিয়ে আসতে হবে। চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সংস্কারক— সবাইকে বর্তমান সমাজ অভ্যন্তরে বিদ্যমান অস্থিরতা এবং যে ধস নেমেছে তা থেকে উত্তরণে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট হতে হবে। নতুবা এ পচন দীর্ঘায়িত হতে হতে মূল শেকড় ধরে টান মারবে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না।

 

লেখক : মুক্তগদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads