• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

পরিবার, শিক্ষা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৪ জানুয়ারি ২০২২

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বৈশ্বিক মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) অংশ হিসেবে একটি জরিপ চালিয়েছে  যার ফল প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ওই প্রতিবেদনে শিশুদের অপূর্ণ শৈশবের একটি  চিত্র উঠে এসেছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসিফের কারিগরি সহায়তায় এতে অর্থায়ন করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল। বিশেষজ্ঞদের মতে সুষ্ঠু শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হচ্ছে শৈশব। শৈশবকালীন বিকাশ একজন মানুষের পরবর্তী জীবনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। প্রাক-শৈশবে মা-বাবার সঙ্গে বন্ধন এবং প্রথম শিখন অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিকাশকে প্রভাবিত করে। তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অভাববোধও হতে পারে। যদিও অপূর্ণতা ছাড়া বেড়ে ওঠা শিশুর ক্ষেত্রেও সেটি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে শৈশবকালে শিশুদের হাতে বই-খেলার সামগ্রী তুলে দেওয়াসহ পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের সঙ্গে রয়েছে রাষ্ট্রের বিশাল দায়িত্ব। 

এক জরিপে দেখা গেছে, মা-বাবার সান্নিধ্য ছাড়াই বড় হচ্ছে শিশুদের একটি অংশ। এর মধ্যে ৪ দশমিক ১ শতাংশ শিশু আছে যাদের বায়োলজিক্যাল মা-বাবা কেউই নেই। ৪ দশমিক ১ শতাংশ শিশু আছে যাদের মা অথবা বাবা দুজনই মারা গেছেন। এছাড়া ৭ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর মা অথবা বাবাকে উপার্জনের তাগিদে পরিবার ছেড়ে দেশের বাইরে থাকতে হয়। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে ভূমিকা রাখে প্রয়োজনীয় খেলা ও পড়ার উপকরণ। সেই সঙ্গে সঠিক তদারকিও। যদিও পাঁচ বছরের কম বয়সি মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ শিশুর কাছে তিন বা তার অধিক শিশুতোষ বই আছে। দুই বা ততোধিক খেলনাসামগ্রী আছে ৬৬ দশমিক ৫ শতাংশ শিশুর। সঠিক তদারকির বাইরে থাকে পাঁচ বছরের কম বয়সি অনেক শিশু। হয় একা থাকে অথবা দশ বছরের কম বয়সি শিশুই দেখভাল করে এমন শিশুর হার কম নয়, ১১ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে প্রাক-শৈশবের উন্নতি সঠিকভাবে হচ্ছে না ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিশুর। তিন বছর থেকে ৫ বছর ১১ মাস বয়সে প্রাক-শৈশব শিক্ষা শুরু হওয়ার কথা। যদিও এ বয়সি ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিশু এ ধরনের শিক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে। নির্ধারিত বয়সে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে না অনেকে। প্রাথমিক ভর্তির এক বছর প্রাক-প্রাথমিকে যাচ্ছে ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু। সঠিক বয়সে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারছে ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু।

মাল্টিপল ক্লাস্টার ইনডিকেটর সার্ভে ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী সাত থেকে ১৪ বছর বয়সি মাত্র ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু ঠিকভাবে পড়তে পারে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া উপযোগীদের মধ্যে এই হার ২০ দশমিক ২ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়াদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। মৌলিক সংখ্যার জ্ঞানও নেই সাত থেকে ১৪ বছর বয়সি ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া উপযোগী শিশুদের মধ্যে এ হার ৯ দশমিক ৮ এবং এ দুই শ্রেণিতে পড়ুয়াদের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। শারীরিক ও মানসিক পীড়নের শিকার হচ্ছে শিশুদের বড় একটি অংশ। জরিপের তথ্য আরও বলছে যে, এক থেকে ১৪ বছর বয়সি ৮৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিশুই কোনো না কোনোভাবে কেয়ারগিভারের কাছ থেকে শারীরিক ও মানসিক পীড়নের শিকার হচ্ছে।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিজ্ঞানী লেভ ভাইগোস্কি খেলাকে শিশুর সামাজিক, আবেগিক, শারীরিক ও ভাষাভিত্তিক বিকাশের প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মনোবিজ্ঞানী ডেভিড এলকিন্ড বলেছেন, খেলা শুধু সৃজনশীল শক্তি না, এটি শেখার মৌলিক ভিত্তি হসেবে কাজ করে। শিশুরা যখন খেলা করে, তখন তারা বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার, অনুসন্ধান, নতুন চিন্তার উন্নয়ন ও তাদের শিক্ষার বিভিন্ন দিক প্রসারিত করার সুযোগ পায়। শিশুরা খেলার মাধ্যমে পারস্পরিক মতবিনিময়, পরিকল্পনা করা, সমস্যা সমাধান, নতুন কিছু সৃষ্টি করা ও বাস্তব জীবনের অনেক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়। বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ফ্রেজার মাস্টার্ডের মতে, খেলা শিশু জ্ঞান বৃদ্ধি করে, কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করে, সৃজনশীল চিন্তাকে প্রসারিত করে, সমস্যা সমাধান, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি ও শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরিতে সহায়তা করে। এই সুযোগ থেকে আমাদের শিশুরা আজ বঞ্চিত। আগেকার দিনের পড়াশোনার ধরন যাই থাকুক না কেন বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা ছিল খোলামেলা। শিশুরা সুযোগ পেলেই, ক্লাস শুরুর আগে ও পরে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে পারত, খেলতে পারত এখন নগর সভ্যতার চাপে, জনসংখ্যার চাপে সেই সুযোগ আর নেই। ঐতিহ্যবাহী কিছু প্রতিষ্ঠান যেগুলো অনেক আগেই তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র সেগুলোতে আছে উন্মুক্ত খেলার মাঠ। বাকি বিদ্যালয় এখন ভাড়া বাড়িতে কিংবা তিন তলা চার তলার ওপর। শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য এ এক মানসিক শাস্তি কিন্তু উপায়তো নেই। তবে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়গুলোকে পরিকল্পিতভাবে সাজালে এবং যত্রতত্র বিদ্যালয় করার উৎসাহ ও অনুমতি না দিলে বড় বড় বিদ্যালয়গুলোতে বহু শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করা যেত যেখানে উন্মুক্ত খেলার মাঠের সুবিধা পেত লাখ লাখ শিশু। সেক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের জন্য শিশুদের উপযুক্ত পরিবহন সেবা থাকতে হবে যাতে করে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশুরা নিরাপদে বিদ্যালয়ে আসতে পারে। শিশুদের পড়াশোনা হতে হবে বিনোদন নির্ভর যেটি আমরা আজও করতে পারিনি, করা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি। চিকিৎসকরা বলছেন যে, বহু শিশু তাদের কাছে আসছে সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পেরে, পিঠে ব্যথা নিয়ে , ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে। এগুলো যে স্কুলব্যাগের ওজনের কারণে হচ্ছে সেটি নিয়ে কেউ সেভাবে ভাবছে না। অনেক অভিভাবকই মনে করেন ‘বই বেশি, বেশি জ্ঞান, বেশি বইয়ের ও পড়ার বোঝা মানে বড় সাফল্য’।

আবার পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান করা হয়। শাস্তির নেগেটিব প্রভাসমূহ, ভয়ভীতি  শিশুকে দারুণভাবে মানসিক কষ্ট দেয়। সহপাঠীদের সামনে অপমানের যন্ত্রণায় শিশু ভীষণভাবে মানসিক কষ্ট পেয়ে থাকে। সে নিজেকে অপরাধী, ছোট ও হীন মনে করে। শারীরিক ক্ষতি সহজে মিটে গেলেও শিশুর মধ্যে অপমানবোধ সহজে শেষ হয় না। আর শিশুর এই অপমানবোধ তাকে বিদ্যালয়, শিক্ষক, পড়ালেখা ও সহপাঠীদের প্রতি অনিহা ও ঘৃণা তৈরিতে সহায়তা করে। কখনো কখনো অপমানের যন্ত্রণা বেশি হওয়ায় শিশু পরবর্তীকালে বিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। শাস্তি, রাগ ও ভয়ে শিশুর মস্তিষ্কে এক ধরনের হরমোন নির্গত হয় যা তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে ক্ষণিকের জন্য বাধাগ্রস্ত করে। এ সময় এ ধরনের নির্গত হরমোন তার মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তির ক্ষেত্রটিতে মেঘের মতো ছায়া ফেলে ঢেকে দেয়। দেখা গেছে, শিশুরা যখন অতিরিক্ত মানসিক দুঃখ, ভয়, ক্রোধ বা মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে তখন অতি সাধারণ কথা বা তথ্যও মনে করতে পারে না। আরও দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটলে শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও আকৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। ভয়ভীতি ও শাস্তির কারণে শিশুরা কম শেখে। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুরা খুবই আনন্দপ্রিয়। তারা আনন্দময় পরিবেশেই বেশি শেখে। পক্ষান্তরে শাস্তি, অপমান ও ভীতিকর বা আনন্দহীন পরিবেশে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অনেক কম শেখে। শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনের দিক থেকে শিশুরা অনেক পিছিয়ে পড়ে। শিশুরা শিক্ষককে দেখে পরোক্ষভাবে শাস্তি বা মারামারি করা শেখে। স্বাভাবিকভাবে শিশুরা অনুরকরণপ্রিয়। শিশুরা পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সরাসারি শিক্ষক থেকে অনুরকরণও করা শেখে। পরবর্তী জীবনে শিশু যখন বড় হয় তখন সে শিক্ষকের মতো শাসনের প্রক্রিয়া হিসেবে শাস্তির প্রয়োগ করে থাকে। বারবার শাস্তি পাওয়ার ফলে শিশুর মনে ক্ষোভ, যন্ত্রণা, দুঃখবোধ ও প্রতিশোধ প্রবণতা জন্ম নেয়। ধীরে ধীরে শিশুর মনমানসিকতায় জেদী, রাগী ও অস্থিরভাব জন্ম নেয়। যা শিশুর পরবর্তী জীবনে খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আচরণে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পায়। শিশু পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাদের সুপ্ত মনের প্রতিভা জাগ্রত হতে বাধার সৃষ্টি হয়। তাই তাদের আনন্দময় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর আনন্দময় শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিশুর সঙ্গে আদর-ভালোবাসা ও আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তার চাহিদা, মানসিকতা ও পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। বৈচিত্র্য নিয়ে আসতে হবে শিক্ষাদান পদ্ধতিতে। খেলার মাঠে খেলা করতে দিতে হবে, উন্মুক্ত জায়গায় ঘুরতে দিতে হবে। মাঝে মাঝে শিশুর সঙ্গে নিজেকে খেলতে হবে, মজার মজার গল্প বলতে হবে। তাকে স্বাধীনতা দিতে হবে ও তার নিজস্বতা প্রকাশ করার সুযোগ দিতে হবে। তার বয়স উপযোগী খেলনা দিতে হবে। বিদ্যালয়ে পিরিয়ডের ফাঁকে শিশুদের বিরতি থাকতে হবে যাতে তারা হাফ ছেড়ে বাঁচতে পারে, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে পারে, হাসতে পারে, মন খুলে কথা বলতে পারে। এগুলো তার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য খুবই প্রয়োজন যা বুঝতে হবে সমাজ, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও অভিভাবকদের।

 

লেখক : শিক্ষা গবেষক

masumbillah65@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads